বাংলাদেশে না এলে কি হয়?

গুলজার। ২৫ মার্চ তোলা ছবি l সুমন ইউসুফ
গুলজার। ২৫ মার্চ তোলা ছবি l সুমন ইউসুফ

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় ভারতে মুক্তি পায় গুলজার পরিচালিত প্রথম ছবি মেরে আপনে। বাংলাদেশের জন্ম হবে কি না, এ যুদ্ধের পর বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবে কি না, তখনো তা ছিল অজানা। কিন্তু নির্মাতা গুলজার এরপরও বাংলাদেশের কথা বললেন তাঁর সেই ছবির মধ্য দিয়ে। একটি গানের দৃশ্যে নিজের মনের কথাটি প্রকাশ করলেন নির্মাতা। যুদ্ধের মধ্যবর্তী সেই সময়ে গুলজার তাঁর ছবির সেই গানের দৃশ্যে দেয়াললিখনে দেখালেন, ‘সেভ পিপল ফ্রম দ্য ম্যাসাকার ইন বাংলাদেশ’। পুরোনো দিনের সেই স্মৃতিগুলো নিয়েই গতকাল কথা বললেন ভারতের প্রখ্যাত কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা ও অস্কারজয়ী গীতিকার গুলজার।
গুলজার প্রথমবারের মতো ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। লেইজার বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে তাঁর এই সফর। গত শুক্রবার সেই প্রতিষ্ঠানের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন গুলজার। আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে তিনি শোনান বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা। অনুষ্ঠানের পরদিন সকালে গুলজার নাশতার টেবিলে কথা বললেন প্রথম আলোর সঙ্গে। বললেন তাঁর পছন্দের বাঙালি সাহিত্যিক ও কবিদের নাম।
শুরুতেই প্রশ্ন ছিল গুলজারের কাছে, ‘জীবনের ৮১তম বছরে এসে প্রথম এলেন বাংলাদেশে, এত দেরি কেন?’ গুলজার বললেন, ‘একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে এলাম।’ কেমন বৃত্ত? জবাবে দারুণ এক গল্প শোনালেন পদ্মভূষণ বিজয়ী এই ভারতীয় নাগরিক। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে সবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে ভারতে এসে পৌঁছেছেন ১৩-১৪ বছর বয়সী সম্পূরাণ সিং কালরা, যাঁর ছদ্মনাম একসময় হয়ে ওঠে গুলজার। সারা দিন খাটাখাটনির পর রাতটা তাঁর কাটত ছোট্ট এক দোকানে। রাতে ভালো ঘুম হতো না তাঁর। তাই দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়ার কষ্ট ঘোচাতে প্রতি রাতে তাঁর সঙ্গী হতো বই। পাশের এক পাঠাগার থেকে প্রতি রাতে ৪ আনার বিনিময়ে একটি করে বই ধার করতেন তিনি। গুলজারকে বই দিতে দিতে একসময় সেই লাইব্রেরির লোকটি অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। নতুন বই তো আর নেই, কী দেবেন গুলজারকে? একদিন লাইব্রেরির খুব ওপরের এক তাক থেকে একটা বই বের করে বাড়িয়ে দিলেন গুলজারের দিকে। সারা রাত সেই বইটি পড়ে গুলজার যেন এক নতুন কল্পনাজগতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। উল্টেপাল্টে ভালো করে দেখলেন বইটি। এমনকি সেই বইটি চুরি করে রেখেও দিলেন নিজের কাছে। গুলজারের জীবনের চুরি করা সেই বইটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন দ্য গার্ডেনার-এর উর্দু অনুবাদ। গল্প শেষ করে গুলজার বললেন, ‘বাগবান নামে সেই বইয়ের অনুবাদ এবার আমি করেছি হিন্দিতে। মনে হচ্ছে, এত দিন সেই বই চুরির যথার্থ মূল্য আমি শোধ করলাম। তাই এরপর বাংলাদেশে না এলে িক হয়? মনে হয়েছে একটা বৃত্ত এখানে এসে সেই পুরোনো দিনগুলোর সঙ্গে মিলল।’
তবে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, গুলজারের মন ছুঁয়ে যায় আরও কয়েকজন বাঙালি কবির কবিতা। যেমন জীবনানন্দ দাশ। ‘বনলতা সেন’-এর প্রথম দুটি লাইন শোনালেন। কবিতাটি নিয়ে বলেন, ‘দারুণ আধুনিকতা রয়েছে তাঁর লেখায়। বিশেষ করে এই “বনলতা সেন” কবিতায়। কবিতাটি অন্য ভাষায় অনুবাদ করা খুব কঠিন। এমনকি এই সময়ে এসেও কবিতাটি একেবারে নতুন যেন!’ গুলজার আরও বলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ আর বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথাও। নজরুলের বিপ্লবী কবিতার চেয়ে প্রেমের গান-কবিতাই নাকি বেশি টানে গুলজারকে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বললেন, ‘প্রেমপত্র লিখে লিখে অভ্যাস করেছি বাংলা লেখার, বাংলা পড়ার। এরপর থেকেই জানতে আর বুঝতে শুরু করলাম বাংলা কবিতায় যে কত আবেগ আর শক্তি রয়েছে।’
বাঙালি মেয়ে রাখিকে বিয়ে করেছেন গুলজার। একসময় বলিউডের সেরা অভিনেত্রীদের একজন ছিলেন রাখি গুলজার।
গুলজার নিয়ে কিছু কথা: ‘তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগি’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’, ‘লাকড়ি কি গাড়ি’-সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা গুলজার। এ আর রহমানের সঙ্গে স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিতে ‘জয় হো’ গানটি লিখে তিনি ঘরে তুলে নেন অস্কার ও গ্র্যামির মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। এ আর রহমানের সুর করা দারুণ জনপ্রিয় ‘ছাইয়া ছাইয়া’ (ছবির নাম:দিল সে), ‘সাথিয়া’র (ছবির নাম:সাথিয়া) মতো গানগুলোও লিখেছেন গুলজার। অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে গুলজার ১৩০টির মতো ছবির জন্য গান লিখেছেন। ২৮ বার মনোনয়ন পেয়ে ১১ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন এ গীতিকার। পরিচালক, গল্পকার, সংলাপ রচয়িতা, আজীবন সম্মাননাসহ গুলজারের ঝুলিতে আছে আরও সাতটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
২২টি ছবি নির্মাণ করেন তিনি। লেখেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও। মওসাম ছবিটি পরিচালনা করে ১৯৭৫ সালে তিনি জেতেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অবশ্য এর আগেই ১৯৭২ সালে কোশেশ ছবির জন্য তিনি পেয়েছিলেন সেরা চিত্রনাট্যকারের জাতীয় পুরস্কারটি। মোট সাতবার এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব জিতেছেন বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তা ছাড়া ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মভূষণেও সম্মানিত করা হয়েছে গুলজারকে ২০০৪ সালে।

কথোপকথনে গুলজার