বাংলাদেশ নিয়ে তিন পরাশক্তির ‘প্রক্সি যুদ্ধ’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তিন পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের বৈদেশিক নীতির বিষয়ে নানা তর্কবিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। জাতীয় স্বার্থ বনাম নৈতিক অবস্থানের আলোকে সেসব বিষয় দেখার চেষ্টা করা হয়েছে তিন পর্বের এই লেখায়। আজ দ্বিতীয় পর্ব

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি , চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াই দানা বেঁধে উঠেছিল, একাত্তর তাতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আঁতাত গঠনের আশঙ্কা প্রকাশিত হওয়ার পর এই মেরুকরণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—এই তিন পরাশক্তির মধ্যে লড়াইয়ে বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়ায় তাদের ‘প্রক্সি’।

সোভিয়েত প্রতিক্রিয়া

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম দেশ হিসেবে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে সরকারি বিবৃতি দিয়েছিল। ২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত ও ‘নিষ্পেষণ’ বন্ধের পাশাপাশি সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হলো। গোপনে রাষ্ট্রদূত অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে নয়, সোভিয়েত বার্তা সংস্থার মাধ্যমে পদগোর্নির বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়, যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ প্রশ্নে কার্যত একটি ‘পক্ষপাতপূর্ণ’ অবস্থান গ্রহণ করে।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষায় আগ্রহী ছিল মস্কো। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাশখন্দ বৈঠকের আহ্বায়ক হিসেবে নিজের নিরপেক্ষতা সে উভয় দেশের কাছেই কমবেশি প্রমাণে সক্ষম হয়েছিল। এই অবস্থায় পাকিস্তান তার পূর্বাংশের ঘটনাবলি নিজের ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপার বলে দাবি করা সত্ত্বেও মস্কোর এই সমালোচনাপূর্ণ প্রকাশ্য অবস্থান বাংলাদেশ প্রশ্নে তার ‘পক্ষপাতিত্ব’ ইসলামাবাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া

ওয়াশিংটন অনেক দিন ধরেই পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জানিয়েছিল, অবস্থা সামলাতে ইয়হিয়া সামরিক শক্তি ব্যবহারে পিছপা হবেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বিশ্বাস ছিল, সামরিক ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ বাঙালির পক্ষে সুশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করা অসম্ভব। ২৯ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপচারিতায় নিক্সন যুক্তি দেখান, মাত্র ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পদানত করার ঘটনা ইতিহাসে বিস্তর রয়েছে। ভারতে ব্রিটিশদের হাতে সেই ঘটনাই ঘটেছে। নিক্সনের এই মনোভাব ব্যাখ্যা করে নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এক সভায় কিসিঞ্জার জানান, ইয়াহিয়া ক্ষুণ্ণ হন, এমন কিছু করতে প্রস্তুত নন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

৯ আগস্ট ১৯৭১ সালে স্বাক্ষরিত হলেও এই চুক্তির প্রথম খসড়া সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল ১৯৬৯ সালে, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের এশিয়ায় একটি ‘যুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা’র প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এই প্রকল্প ছিল এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট সিয়াটো ও সেন্টো গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে। ব্রেজনেভ যে যৌথ নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাব দেন, তাতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের অন্তর্ভুক্তির কথা ভাবা হয়েছিল। এতে চীন নেই—এ যুক্তিতে পাকিস্তান প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।

ঢাকায় যে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে, এ কথা উপেক্ষা করা মার্কিন সরকারের পক্ষে কঠিন ছিল। ঢাকা থেকে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক গোপন বার্তায় জানিয়েছিলেন, ঢাকায় যা হচ্ছে তা ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ ছাড়া আর কিছু নয়। এই অবস্থায় ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউস প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ায় যা জানাল, তার মোদ্দা অর্থ হলো, পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা দেশটির ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’। এই বক্তব্য এতই অবাস্তব ছিল যে ৭ এপ্রিল হোয়াইট হাউসকে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে নতুন বক্তব্য দিতে হলো। এবার বলা হলো, সংঘর্ষ বন্ধে শান্তিপূর্ণ সমাধানে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

চীনা প্রতিক্রিয়া

পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার ব্যাপারে চীনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল কিছুটা ভিন্ন। তারা পাকিস্তানি হামলা শুরুর প্রথম সপ্তাহ এ ব্যাপারে কার্যত নীরব থাকে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কোনো বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়নি। চীনের সরকারি দৈনিক পিপলস ডেইলিতে প্রথম মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো ১ এপ্রিল। তাতে বলা হলো, পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ভারতের আইন পরিষদে এই প্রশ্নে যে নিন্দাজ্ঞাপক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। একই যুক্তিতে প্রতিবেদনটিতে মস্কো ও ওয়াশিংটনের বক্তব্যেরও নিন্দা করা হলো।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের প্রতি শব্দাড়ম্বরপূর্ণ সমালোচনায় অভ্যস্ত চীনা তথ্যমাধ্যমের জন্য পিপলস ডেইলির বক্তব্য ছিল অতি নিরীহ। পাকিস্তান তার দীর্ঘদিনের মিত্র, ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক বৈরিতাপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল নিকট ও হৃদ্যতাপূর্ণ। এ অবস্থায় ঢাকায় পাকিস্তানি হামলা প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণের বদলে সতর্ক ও ধীরগতিতে এগোনোর বিষয়ে চীনের আগ্রহ ছিল।

৩০ মার্চ চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে লেখা এক চিঠিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে তাঁকে সমর্থন করে এক জোরালো বিবৃতির অনুরোধ করেন। চৌ সে পত্রের জবাব পাঠালেন ৯ এপ্রিল। তাঁর মোদ্দা বক্তব্য ছিল, ইয়াহিয়ার সুযোগ্য নেতৃত্বে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হবে, চীন তেমন আশা করছে। খুব জোরালো ভাষায় না হলেও এতে ভারতের নিন্দা করার পাশাপাশি চীনা প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান ও তার জনগণকে নিজেদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে তাদের পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দিলেন।

বাংলাদেশের গণহত্যার আগে থেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দূতিয়ালিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিসিঞ্জারের ভাষ্যে, এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য ইয়াহিয়া বিগড়ে যান, এমন কিছু করার বিরোধী ছিলেন নিক্সন।

একাত্তর ও পরাশক্তির ‘প্রক্সি যুদ্ধ’

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের নিন্দা করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখ্য আগ্রহ ছিল কোনো সামরিক সংঘর্ষ ছাড়াই এ বিবাদের মীমাংসা। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান মুখ্যত কূটনৈতিক চালাচালির মধ্যেই সীমিত ছিল। অবস্থা বদলে যায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন আঁতাতের আশঙ্কায়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি।

৯ আগস্ট ১৯৭১ সালে স্বাক্ষরিত হলেও এই চুক্তির প্রথম খসড়া সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল ১৯৬৯ সালে, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের এশিয়ায় একটি ‘যুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা’র প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এই প্রকল্প ছিল এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট সিয়াটো ও সেন্টো গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে। ব্রেজনেভ যে যৌথ নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাব দেন, তাতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের অন্তর্ভুক্তির কথা ভাবা হয়েছিল। এতে চীন নেই—এ যুক্তিতে পাকিস্তান প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।

অন্যদিকে ভারতের অবস্থান ছিল কিছুটা সতর্কতামূলক। নিজের জোটনিরপেক্ষ পরিচয় অমলিন রাখতে আগ্রহী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে খোলামেলা গাঁট বাঁধতে দ্বিধায় ছিলেন। ভারতীয় নেতৃত্বের মনোভাব বদলে যায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুদ্ধ অনিবার্য, এ কথা ভারতীয় মহলে বলা হলেও তাদের প্রধান ভীতি ছিল চীনকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার আঁতাত হচ্ছে, এ কথা জানার পর এই ভীতি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

১৯৭১ সালের মাঝামাঝি পাকিস্তানের সহায়তায় গোপনে পিকিং থেকে ঘুরে এলেন হেনরি কিসিঞ্জার। ঘটনাটি শুধু ভারতকে নয়, মস্কোকেও বিস্মিত করেছিল। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র জোট বাঁধছে, তা শুধু ভারতের জন্য নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যও উদ্বেগের কারণ, এই বিবেচনা উভয় দেশকে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনে ঠেলে দেয়।

নিক্সন, কিসিঞ্জার ও ‘ব্যক্তিগত বিদ্বেষ’–এর রাজনীতি

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি একধরনের ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণে আগ্রহী ছিল, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এই কথার সঙ্গে একমত। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক রবার্ট জ্যাকসন যেমন বলেছেন, কমিউনিস্টবিরোধী সামরিক জোট সিয়াটো ও সেন্টোতে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির ফলে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যে সামরিক আঁতাত জোরালো হয়। এই সম্পর্ক যাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে, সে জন্য ওয়াশিংটন নয়াদিল্লির সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার লক্ষ্য যদি হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানো, তো ভারতকে হাতে রাখার উদ্দেশ্য ছিল চীনকে ‘বাড়তে না দেওয়া’।

এই সমীকরণ কিঞ্চিৎ বদলে যায় সত্তর দশকের গোড়ার দিকে, যখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই কাজে তিনি সঙ্গে পান তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধ দরজা যদি খুলে যায়, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করা সম্ভব হবে। কাকতালীয়ভাবে এ কাজে তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন পাকিস্তানের সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশের গণহত্যার আগে থেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দূতিয়ালিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিসিঞ্জারের ভাষ্যে, এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য ইয়াহিয়া বিগড়ে যান, এমন কিছু করার বিরোধী ছিলেন নিক্সন।

আরেকটি ক্ষেত্রে নিক্সন ও কিসিঞ্জার সমমত পোষণ করতেন, আর তা হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ। ১৯৫৩ সালে প্রথমবার ভারত সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরার সঙ্গে পরিচিত হন নিক্সন। এই ব্রাহ্মণ পরিবারের উচ্চম্মন্যতায় বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে দ্বিতীয়বার ভারতে ব্যক্তিগত সফরে এসে ইন্দিরার প্রতি নিক্সনের এই বিরক্তি প্রায় বিদ্বেষে পরিণত হয়। এর বিপরীতে নিক্সনের চোখে পাকিস্তানের দুই সামরিক শাসক আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খান ছিলেন ‘চমৎকার ভদ্রলোক’।

চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন মার্কিন জাতীয় স্বার্থ বলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সে জন্য বাংলাদেশে নারকীয় গণহত্যার কেন নিন্দা করা যাবে না, মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে ব্যাপারটা কোনোক্রমেই বোধগম্য হচ্ছিল না। চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য দূত হিসেবে শুধু ইয়াহিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে, কিসিঞ্জার-নিক্সনের এই বক্তব্যও সঠিক নয়। এই দাবি যাঁরা করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন ক্রিস ভ্যান হলেন। ১৯৭১ সালে তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেটের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ভ্যান হলেন কিছুটা বিদ্রুপের স্বরেই বলেন, নিজের পক্ষে যুক্তি দেখাতে তিনি নিজের বইতে যত পাতাই ব্যয় করুন না কেন (৭৬ পাতা), বাংলাদেশ প্রশ্নে কিসিঞ্জার যা বলেছেন, তা মোটেই ঠিক নয়। চীনের সঙ্গে ‘দরজা খুলতে’ ইয়াহিয়ার দ্বারস্থ হওয়ার যে খোঁড়া যুক্তি তিনি দিয়েছেন, তার জন্য বাংলাদেশে গণহত্যা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীরব থাকার কোনো কারণই ছিল না। ভ্যান হলেন স্মরণ করেছেন, ইয়াহিয়াই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না, যাঁর মাধ্যমে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত। একই কাজ রুমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই চৌসেস্কুর মাধ্যমেও করা যেত। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়াকে এই কাজে সাহায্য করার যে প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে করা হয়, একই সময়ে সে প্রস্তাব চৌসেস্কুর কাছেও দেওয়া হয়েছিল।

পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের সাফাই হিসেবে কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। ভ্যান হলেনের মতে, চীনের সঙ্গে আঁতাতের যে গোপন তৎপরতা নিক্সন-কিসিঞ্জার চালাচ্ছিলেন, তা-ই ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঠেলে দেয়।

বাংলাদেশের বিপক্ষে চীন

বাংলাদেশের ভেতর যে গণহত্যা চলছে, এ কথা চীনাদের অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। অথচ বিশ্বের তাবৎ পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে দীর্ঘ সচিত্র বিবরণ ছাপা হলেও চীনা পত্রিকায় তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ ছিল না। চীনা নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ না করলেও মাওপন্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর ঠিকই রাখতেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পিকিংয়ে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়ার বাঙালি উপদেষ্টা জি ডব্লিউ চৌধুরী সেই সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, চৌ এন লাই ভুট্টোর কাছে নিজে অভিযোগ করেছিলেন, পাকিস্তানি সেনা হামলায় ৬৪ জন পিকিংপন্থী রাজনীতিবিদ ও কর্মী নিহত হয়েছেন। একই সফরের সময় চৌ এন লাইয়ের উপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি পাকিস্তানি অতিথিদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে যাঁরা সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত, তাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাড়া আর কেউ নয়। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কে চীন ঠিক এই যুক্তিই অনুসরণ করে।

একাত্তরে চীনারা পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি সেনা পাঠায়নি, এ কথা ঠিক; কিন্তু তাদের পাকিস্তানি বন্ধুদের জন্য সামরিক সাজসরঞ্জাম প্রেরণে খুব কার্পণ্য করেছে, তা–ও বলা যাবে না।

পাকিস্তানি অনুরোধ ও মার্কিন উসকানি সত্ত্বেও চীন পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি সেনা নামায়নি, মূল কারণ ছিল সোভিয়েত প্রতি-আক্রমণের ভীতি। আগস্টের মাঝামাঝি ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীন সতর্ক হয়ে পড়ে।