বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে আগুন

>

আধা ঘণ্টা পর আগুন িনয়ন্ত্রণে 
পুড়ে গেছে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের জিএমের কক্ষ
রাতেই দুটি তদন্ত কমিটি গঠন

রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ১৪ তলায় গতকাল রাতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আধা ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন িনয়ন্ত্রণে আনেন l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ১৪ তলায় গতকাল রাতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আধা ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন িনয়ন্ত্রণে আনেন l ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ তলায় আগুন লাগার আধা ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তা নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে এ সময়ের মধ্যে কয়েকটি চেয়ার-টেবিল ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্র পুড়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩১ তলা ভবনের ১৪ তলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) কক্ষে আগুন লাগে। রাত ১০টার দিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও ঢাকা মেট্রোপলিটন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে আসেন। এ ঘটনা তদন্তে রাতেই দুটি আলাদা কমিটি গঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের তিনটি ভবনের মধ্যে উঁচু ৩১ তলা ভবন থেকেই সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ব্যাংকগুলোর সব ধরনের নথিপত্র জমা থাকে এ ভবনেই। ১৪ তলায় বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোর সব ধরনের বৈদেশিক ব্যবসা, ঋণপত্র খোলা ও ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।
যেখানে আগুন লেগেছিল, ওই ভবনের নিচতলাতেই ছিল ক্যাশ কাউন্টার। ওই ভবনে ছোট ভল্টও রয়েছে। জমা হওয়া স্বর্ণ, বিদেশি মুদ্রাও থাকে এ ভবনটিতে। এ ছাড়া এই ভবন থেকে সুইফটের (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন) কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন লেনদেনসহ রিজার্ভের অর্থ পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ, বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস, রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টসহ সব ধরনের কার্যক্রম ওই ভবন থেকেই পরিচালিত হয়। এসব প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অনলাইন ব্যাংকিং পরিচালিত হয়।

রাত ১১টার পর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান ব্যাংকের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মাসউদ বিশ্বাসের কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনে কক্ষটির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কাগজপত্র ও চেয়ার-টেবিল পুড়ে গেছে। এখানে কম্পিউটারের ইউপিএস ও ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এসব থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে। তবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এটি নাশকতা কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তিনি বলেন, এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে। গোয়েন্দারা কাজ করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ১৪ তলায় আগুন জ্বলছে l প্রথম আলো
বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ১৪ তলায় আগুন জ্বলছে l প্রথম আলো

এই প্রতিবেদক রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত সোয়া নয়টার দিকে নিরাপত্তাকর্মীরা ১৪ তলা থেকে আগুন ও ধোঁয়া বের হতে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভাতে অংশ নেয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লেডার (বিশেষ ধরনের মই) ব্যবহার করে ব্যাংক ভবনটিতে ঢোকেন। তাঁরা ১৪ তলায় ঢুকে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানো শুরু করেন। এ সময় ব্যাংক ভবনের পাশের কোয়ার্টার থেকে কর্মকর্তারা আসেন। পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা সতর্কতামূলক অবস্থান নেন। ব্যাংকের প্রধান ফটকে পুলিশ ও ব্যাংকের নিরাপত্তা কর্মীরা অবস্থান নেন। এ সময় ওই ফটক দিয়ে ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আধা ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

ব্যাংক ভবনের দক্ষিণ পাশে অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে আগুন লাগার ঘটনাটি দেখেন ব্যাংকের উপপরিচালক আবুল হোসেন। তাঁর মতো কোয়ার্টারে থাকা অনেকে ছুটে আসেন। ব্যাংকের সহকারী পরিচালক তপন কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ তলায় অনেক কম্পিউটার, ডেস্ক আছে। এসব ডেস্কে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র থাকে। এ ছাড়া ওই তলায় বেশ কিছু স্টিলের আলমারি আছে। এতে ফাইলপত্র থাকে।

এরই মধ্যে দেখা যায়, ব্যাংকের সামনের সড়কটি বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। পুলিশ উৎসুক মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছে। ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গিয়ে ব্যাংকটির ১৪ তলায় পোড়া চিহ্ন দেখা যায়। সেখান থেকে পোড়া গন্ধ আসছিল।

সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশনস (কেপিআই) ঘোষণা করা হয়। এখানে রাত আটটার মধ্যে ব্যাংকের কর্মকর্তারা কাজ সেরে বের হয়ে যান। এরপরও এখানে বিভিন্ন সময়ে চুরির ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ভল্ট থেকেও টাকা চুরির খবর বের হয়েছিল। এ ছাড়া গত বছরে দুজন বিদেশি টাকা চুরি করে ধরা পড়েন। গতকালের আগুনের ঘটনায় ব্যাংকের ভেতরে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত এ নিয়ে গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের প্রায় সব বিপণিবিতান, উঁচু ভবনেই নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়েও এখানে এসব ব্যবস্থা নেই। একটি বড় অগ্নিকাণ্ড ব্যাংক খাতকে কয়েক দিন অচল করে দিতে পারে।

তদন্ত কমিটি গঠন

রাতে সভা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এর প্রধান করা হয়েছে নির্বাহী পরিচালক আহমেদ জামালকে। এ-সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়েছে, রাত ৯টা ২০ মিনিটে ১৪ তলায় আগুনের শিখা দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিস ৩০ মিনিটের মধ্যে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনে। এ আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হলো। কমিটিকে ২৮ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ সংস্থাটির ঢাকা বিভাগের উপপরিচালককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।