বাধ্য হয়ে রাস্তায়, তবু চলছে না সংসার

লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন অটোরিকশাচালক মো. শাহাজাদা। সংসারের খরচ জোগাতে বাধ্য হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন রাস্তায়। কিন্তু যাত্রী কম থাকায় মালিকের ভাড়ার টাকাও উঠছে না। গতকাল বিকেল ৩টায় নগরের উত্তর কাট্টলী এলাকায়।
ছবি: জুয়েল শীল

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন শুরু হওয়ার পর দুই সপ্তাহ সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হননি আবদুল করিম। ধার করে চালিয়েছেন সংসার। ধার করা টাকাও শেষ হয়ে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।

পুলিশের কড়াকড়ি চোখরাঙানি এড়িয়ে ভাড়া যা পান, তার সিংহভাগই তুলে দিতে হয় গাড়ির মালিককে। আবদুল করিমের মতো চট্টগ্রাম শহরের ৩০ হাজার অটোরিকশা ও টেম্পোর চালক-শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। লকডাউনের সময় সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের সহায়তা পাননি তাঁরা।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে শহরের ২ নম্বর গেট এলাকার কর্ণফুলী শপিং কমপ্লেক্সের সামনে অটোরিকশা নিয়ে যাত্রীর আশায় দাঁড়িয়েছিলেন আবদুল করিম। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেও ভাড়া মেলেনি। তিনি বললেন, তাঁর সংসারে স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা মিলিয়ে পাঁচজন। লকডাউনের আগে অটোরিকশা চালিয়ে সারা দিনে আয় হতো কমপক্ষে ২ হাজার টাকা। কিন্তু এখন আয় হয় কোনো দিন ১ হাজার, কোনো দিন ৬০০ টাকা। আয় যা-ই হোক ৮০০ টাকা দিতে হয় অটোরিকশার মালিককে। ফলে কখনো কখনো শূন্য হাতে ঘরে ফিরতে হয় তাঁকে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. মুছা বলেন, চট্টগ্রাম নগরে ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং ১০ হাজার টেম্পো রয়েছে। এ খাতে মোট ৩০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন।

লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এখন পর্যন্ত এই শ্রমিকদের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি।

মালিককে দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। তেল কিনতে লাগে আরও ২০০। ফলে ২ হাজার টাকার ওপরে আয় না হলে ঘরে কোনো বাজারই নেওয়া যায় না। গতকাল আয় হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন মালিককে কত দেব, আর বাসায় কী নেব।
শাহাজাদা, টেম্পো চালক

গতকাল রাস্তাঘাট, হাটবাজার ছিল সুনসান। সকালে দুই ঘণ্টা বটতলী স্টেশন পাড়ে বসে থেকেও কোনো ভাড়া পাননি সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক হানিফ মিয়া। দিনের আয়-রোজগার নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় আছেন তিনিও।

হানিফ মিয়া প্রথম আলোকে বললেন, সকাল আটটায় কায়দা করে গাড়ি নিয়ে বের হন তিনি। পথে পুলিশ আটকালে দুর্দশার কথা বুঝিয়ে বলেন। মামলার ভয় নিয়ে পথে বের হতে হয়। সারা দিনে আয় বলতে ৭০০ টাকার মতো। গাড়ির মালিককে দিতে হবে অর্ধেক। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চলবে। অথচ লকডাউনের আগে দেড় হাজার টাকার নিচে আয় হয়নি।

হানিফ মিয়া বলেন, ‘মার্কেট, দোকানপাট, হাটবাজার খোলা। প্রাইভেট গাড়ি চলছে। শুধু সিএনজি নিয়ে বের হলেই পুলিশ ধরে। এর থেকে মুক্তি মিলবে কবে।’

অনু দাশের বয়স ৫৫ পেরিয়েছে। থাকেন উত্তর কাট্টলীর কালীবাড়ি এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে শহরের রাস্তায় তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন। কিন্তু কখনো রাতে গাড়ি চালাতে হয়নি। লকডাউন আসার পর দিনে গাড়ি চালানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

পরে বাধ্য হয়ে রাতেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। কিন্তু রাস্তায় মানুষ না থাকায় গ্যাসের টাকাই উঠছে না।

অনু দাশ জানালেন, দুই হাজার টাকার নিচে আয় হতো না কদিন আগেও। বর্তমানে আয় কয়েক গুণ কমে গেছে। করোনার ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালের যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। কাঁচাবাজারের পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। তাও কাঙ্ক্ষিত ভাড়া উঠছে না। অভাবের সংসারে কারও সাহায্যও পাচ্ছেন না।

কল্যাণ তহবিলের নামে পরিবহন খাতে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। পরিবহনশ্রমিকদের এ দুর্দশার সময় কেউ পাশে নেই। সরকারের উচিত পরিবহনশ্রমিকদের পাঁচ হাজার টাকার খাবার ও পাঁচ হাজার টাকা নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এতে অন্তত এক মাস তাঁরা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারবেন।
হাসান মারুফ, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক

মো. শাহাজাদার ঘরে চাল, ডাল ফুরিয়ে গেছে। বাজারে কোনো পণ্যই তাঁর হাতের নাগালে নেই। দুই মাস আগে প্রাইভেট কার চালানোর চাকরিটা হারিয়ে তাঁর জীবনে এ বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরে চাল, ডালের ব্যবস্থা করতে তিনি টেম্পো চালানো শুরু করেন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সে কাজটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার শুরু করেন টেম্পো চালানো। টেম্পো নিয়ে বের হলে মালিককে দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। লকডাউনে সেই টাকাও উঠে আসে না। গতকাল সারা দিনে শাহাজাদার আয় হয়েছে ১ হাজার ২২০ টাকা।

শাহাজাদা আক্ষেপ করে বলেন, ‘মালিককে দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। তেল কিনতে লাগে আরও ২০০। ফলে ২ হাজার টাকার ওপরে আয় না হলে ঘরে কোনো বাজারই নেওয়া যায় না। গতকাল আয় হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন মালিককে কত দেব, আর বাসায় কী নেব। এভাবে আর কদিন গেলে না খেয়ে মরতে হবে।’

ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক হাসান মারুফ রুমি প্রথম আলোকে বলেন, কল্যাণ তহবিলের নামে পরিবহন খাতে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। পরিবহনশ্রমিকদের এ দুর্দশার সময় কেউ পাশে নেই। সরকারের উচিত পরিবহনশ্রমিকদের পাঁচ হাজার টাকার খাবার ও পাঁচ হাজার টাকা নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এতে অন্তত এক মাস তাঁরা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারবেন।