বাবারা কেন বৃদ্ধাশ্রমে
সন্তানের জন্য পরম আদর্শ আর নির্ভরতার অন্য নাম বাবা। বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে আমাদের আগলে রাখেন আমৃত্যু। বাবাদের ভালোবাসা মায়ের মতো প্রকাশিত হয় না। নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে তাঁরা সন্তানের সুখ কেনেন। কাউকে না জানিয়ে নিজে কষ্ট করে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতেই ওনারা সদা ব্যস্ত। অথচ জীবনের পড়ন্ত বিকেলে সন্তানের কাছে হয়ে ওঠেন বোঝা, বাড়তি ঝামেলা। এমনকি শেষ আশ্রয়স্থল হয় বৃদ্ধাশ্রম!
আপনি কখনো ভেবেছেন যে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হবে? উত্তর অবশ্যই হবে, না! বৃদ্ধাশ্রম মূলত বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল বা আবাসস্থল! এর উৎপত্তি সম্ভবত অসহায় দরিদ্র সহায়-সম্বলহীন, সন্তানহারা বৃদ্ধদের শেষ জীবনে বিশেষ সেবা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে এর সংজ্ঞা পুরোপুরি ভিন্ন। এখন বৃদ্ধাশ্রমগুলো হলো পরিবার–পরিজন থেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতার পৃথক নিবাস বা আশ্রয়ের নাম।
যে বাবা সন্তানকে একদিন না দেখে থাকতে পারতেন না, সে সন্তান আজ বাবাকে ছাড়া আরামসে দিনযাপন করছে। এই বাবাই একদিন ছিলেন বড় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। এখন যারা বৃদ্ধ, তাঁদের ধনসম্পদ ও সময়ের সবটুকুই বিনিয়োগ করেছেন সন্তানদের পেছনে। আপনার আজ বড় হওয়ার পেছনে যিনি স্বপ্নদ্রষ্টা, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, দুর্বার গতি আর চলমান অর্থের জোগান দিয়েছেন; তিনি আপনার বাবা! আজ তাঁর অর্থের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন ভালোবাসার, সান্নিধ্যের, মমতার। প্রিয়জনদের মধুর বাণী, একটু সম্মান আর গুরুত্ব পেলে ওনারা হয়ে ওঠেন প্রস্ফুটিত বাগান।

কথায় আছে, বৃদ্ধ বয়স আর বাচ্চা বয়স সমান। পার্থক্য এতটুকুই যে আপনি বাচ্চাদের ওপর রেগেমেগে প্রহার করেন বা বকাঝকা করেন। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তেমন হয় না (দুর্ভাগ্য যে কিছু পরিবারে ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়)। প্রকৃতপক্ষে উভয়ের ক্ষেত্রেই ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে কার্যোদ্ধার করতে হয়। অনেক পরিবারে বউ এলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বনিবনা হয় না, আপন করে নিতে পারে না। থাকার জায়গা, নিয়মিত খাবার, ওষুধ, সেবা ও সময় দিতে ঝক্কি–ঝামেলা মনে করে। যদি মা–বাবার দুজনের মধ্যে কোনো একজন পরলোকগমন করেন অপরজনের অবস্থা তখন আরও শোচনীয় হয়। নিজেদের নিঃসঙ্গতা তখন তাদের শরীর ও মনকে অশান্ত ও রোগীতে পরিণত করে। কিছু পরিবারে তখন বৃদ্ধ মা–বাবার সঙ্গে এমন আচরণ করা হয় যেন সে আপনা থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হন কিংবা জোর করেই সেখানে রেখে আসা হয়। ব্যাপারটি কিছুতেই সুখকর নয়।
অপরদিকে একজন দাদা বা নানা (পক্ষান্তরে দাদি বা নানিও) নাতি–নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে কতই না পুলকিত হন। আপনার পরে আপনার সন্তানদের লালনপালনেও বিশাল অবদান তাঁরা রাখেন। জ্ঞান বিতরণ, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি, ভালো আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য জানা ও মানায় আপনার ঘর হয়ে ওঠে আলোকিত! এমন সৌভাগ্য কজনার ভাগ্যে জুটে?

আমাদের অসহায়ত্বের সময় মা-বাবা যেমন স্নেহভরে লালন–পালন করেছেন, আমাদেরও উচিত বৃদ্ধাবস্থায় তাঁদের সব চাহিদা পূরণ করা। তাঁদের আগলে রাখা, তাঁদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা।
আর কোনো বাবার আশ্রয় যেন না হয় বৃদ্ধাশ্রম। কারাগারের মতো বন্দিত্ব বরণ না করুক কোনো পিতা। বৃদ্ধাশ্রমের জানালা ধরে অপলক চাহনি মিথ্যা প্রতিপন্ন হোক। জীর্ণশীর্ণ দেহ–মন আর স্বচ্ছ চোখ দুটি থেকে ঝরে না পড়ুক আর একফোঁটা অশ্রু।
*প্রভাষক, উদ্ভিদবিজ্ঞান, জুরানপুর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, দাউদকান্দি, কুমিল্লা