বাসে ওঠার পরই গলায় ছুরি

চারটি ডাকাত দলের ৩৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তাঁরা বাসে যাত্রীবেশে ডাকাতি করতেন।

  • গত এক মাসে ঢাকা, সাভার ও টাঙ্গাইলে বাসে সংঘটিত মোট ছয়টি ডাকাতির ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে।

  • ডিএমপির মাসিক অপরাধ সভায় চুরি-ছিনতাই ও যাত্রীবাহী পরিবহনে ডাকাতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

  • ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশের পর অভিযানেজোর আসে।

ফাইল ছবি

রাত সাড়ে ১২টা। সাভার ব্যাংক টাউন বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন দুই ভাই ওমর ফারুক ও আবদুল্লাহ আল মাসুদ। একটি বাস এসে দাঁড়ালে ছোট ভাই মাসুদ এগিয়ে গিয়ে জানতে চান, বাসটি ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যাবে কি না। উত্তরে চালকের সহকারী (হেলপার) বলেন যাবে, তবে ভাড়া লাগবে ২০০ টাকা।

দর-কষাকষি করে ভাড়া দেড় শ টাকায় নামিয়ে বাসে উঠে পড়েন দুই ভাই। তবে ওঠার পরই বাসের দরজা বন্ধ করে দুই ভাইয়ের গলায় চাকু ধরেন যাত্রীবেশে থাকা ডাকাতেরা। দুই ভাইকে হাত-পা বেঁধে মারধর করা হয়। এভাবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সাভারের বিভিন্ন সড়কে বাসটি ঘুরিয়ে দুই ভাইয়ের মুঠোফোন, টাকা ও ডলার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের বলিয়াপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ফেলে বাস নিয়ে ডাকাতেরা চলে যায়।

ঘটনাটি ঘটেছে গত ১০ জানুয়ারি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) গত পাঁচ দিনে চারটি ডাকাত দলের ৩৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে সাভারের ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ডাকাতেরাও রয়েছেন।

ডিবি জানিয়েছে, মহাসড়কে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত চারটি ডাকাত দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর গত এক মাসে ঢাকা, সাভার ও টাঙ্গাইলে বাসে সংঘটিত মোট ছয়টি ডাকাতির ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। ডাকাতেরা কখনো যাত্রী সেজে বাসে ওঠে এবং কখনো বনভোজনে যাওয়ার কথা বলে মালিকদের কাছ থেকে বাস ভাড়া নিয়ে মহাসড়কে ডাকাতি করত। বাসে ডাকাতিকালে তারা বিভিন্ন সময় পাঁচজনকে খুন করেছে।

ডিবির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই দিনে বাস চালান, রাতে ডাকাতি করেন। ডাকাতির সময় একজন আরেকজনকে মাস্টার, মামু ও বিলাই বলে ডাকেন। যাতে পরে কেউ তাঁদের নাম পুলিশকে বলে দিতে না পারেন।

শুধু গ্রেপ্তার নয়, ডাকাতদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে তারা বারবার জেল থেকে বেরিয়ে একই অপরাধে জড়িত হতে না পারে।
আকিব হাসান, ঢাকা-মানিকগঞ্জ রুটের যাত্রী

সেই রাতের বর্ণনা

সাভারে বাসে উঠে ডাকাতের কবলে পড়া দুই ভাইয়ের একজন আবদুল্লাহ আল মাসুদ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে জানান তাঁদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। তিনি জানান, ১১ জানুয়ারি ভোরে তাঁর বড় ভাই ওমর ফারুকের সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। তাই আগের রাতে তাঁরা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন। তিনি বলেন, ‘বাসটিতে ১৫ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। তাই আমাদের সন্দেহ হয়নি। পরে বুঝতে পারি ১৫ জনের মধ্যে ১০ জন ছিল ডাকাত। বাকিরা ছিল সাধারণ যাত্রী।’ আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘আমাদের কাছে ব্যাংকের কার্ড ছিল। ডাকাতেরা কার্ডের পিনের (গোপন নম্বর) জন্য মারধর করে। হত্যার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে চাকু দিয়ে পায়ে খোঁচাতে শুরু করে। পরে পিন নম্বর দিলে তারা সাভারে ব্যাংকের বুথে গিয়ে ২৮ হাজার টাকা তুলে নেয়।’

যে কারণে জোর অভিযান

ডাকাত দলগুলোকে ধরতে ডিবি অভিযান জোরদার করেছিল ঢাকার আবদুল্লাহপুরের একটি ঘটনার পর। ঘটনাটি হলো গত ২১ জানুয়ারি রাতে আবদুল্লাহপুর থেকে বাসে টাঙ্গাইলে যাওয়ার পথে চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম ডাকাতের কবলে পড়েন। সাত থেকে আট ঘণ্টা পর তাঁকে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় ফেলে যায় ডাকাতেরা।

শফিকুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিযোগ করেন, যাত্রাবাড়ী থানা তাঁর মামলা নেয়নি। তাঁর পোস্টটি ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। গত সপ্তাহে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই ও যাত্রীবাহী পরিবহনে ডাকাতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা ধরে ডিবিকে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন।

দিনে ডাব বিক্রেতা, রাতে ডাকাত

ডিবি জানিয়েছে, মহাসড়কে ডাকাতিতে জড়িত যে চারটি দলকে শনাক্ত করা হয়েছে, তার প্রতিটি দলে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-টাঙ্গাইল, আবদুল্লাহপুর-গাজীপুর এবং ঢাকা থেকে রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ রুটে বাসে ডাকাতি করেন। ডাকাত দলের গ্রেপ্তার তিন সদস্য দিলীপ, আলামিন ও নাইমুর রহমান গত সপ্তাহে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

ডিবি বলছে, ডাকাত দলের গ্রেপ্তার সদস্যদের মধ্যে দিলীপ, আলামিন ও আবু জাফর ওরফে বিপ্লব তিনটি দলের প্রধান। আরেকটি দলের প্রধানকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁদের মধ্যে দিলীপ নবীনগর ও আশুলিয়া এলাকায় দিনের বেলা ডাব বিক্রি করেন। তিনি ২০ বছর ধরে ডাকাতি করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ তিনটি মামলা রয়েছে। আলামিনের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলাসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে। আবু জাফর ২০১৬ সালে আশুলিয়া এলাকায় বাসে ডাকাতির সময় দুই যাত্রীকে খুন করেন।

ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ রুটে নিয়মিত চলাচলকারী আকিব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু গ্রেপ্তার নয়, ডাকাতদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা বারবার জেল থেকে বেরিয়ে একই অপরাধে জড়িত হতে না পারে।