বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন বার্তা?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা তৃতীয়বার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায়।
ফাইল ছবি: এএনআই

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর দলনেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের অভিনন্দন বার্তা যথেষ্ট আগ্রহ সঞ্চার করেছে। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, মোমেনের ওই চিঠি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দলের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধেও এক প্রচ্ছন্ন বার্তা।

পশ্চিমবঙ্গ দখলে ভারতের শাসক দল বিজেপি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। টানা দুই মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, দলের সভাপতি জে পি নাড্ডাসহ শীর্ষস্থানীয় সব নেতা রাজ্যে প্রচার চালিয়েছেন। এই প্রথম রাজ্যের নির্বাচনকে ধর্মীয় আধারে করার চেষ্টা হয়েছিল। বিজেপি নেতারা ভোট প্রচারে সরাসরি ‘বিভাজনের নীতিকে’ প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোট চলাকালীন বাংলাদেশ সফরে গিয়ে ওড়াকান্দিতে হিন্দু ধর্মীয় গুরুর মন্দিরে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) চালু করবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
ফাইল ছবি

এই আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি নিয়ে বাংলাদেশ শুরু থেকেই যথেষ্ট সংশয়ী ও শঙ্কিত। এতটাই যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সরাসরি এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ভোটে বিজেপির বিপর্যয় ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় সেই স্বস্তির ছোঁয়া স্পষ্টতই পরিলক্ষিত। সেটাই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে আগ্রহ জাগিয়েছে।
অবশ্য ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ চিঠির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

গতকাল বুধবার মমতাকে লেখা মোমেনের চিঠির গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো, ‘আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ আপনি বাঙালির দীর্ঘ লালিত মূল্যবোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ ধারণ করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরাসরি বুঝিয়ে দিল দিল্লির ‘ঘৃণা ও বিভাজনের’ রাজনীতিকে তারা প্রত্যাখ্যান করছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মোমেনের এই অভিনন্দন বার্তা সে অর্থে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় নেতাদের অসংবেদী মন্তব্য এবং ভারতে সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের বিরুদ্ধে এক মোক্ষম জবাব।’

সাবেক কূটনীতিক পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, ‘মোমেনের অভিনন্দনবার্তা কূটনৈতিক প্রটোকলের দিক থেকে নিখুঁত।’ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্ক বরাবরই বিশেষ ধরনের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের চোখে একজন ধর্মনিরপেক্ষ নেত্রী। এনআরসি ও সিএএ নিয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট চিন্তিত ছিল। মমতার জয় সেই চিন্তা কিছুদিনের জন্য হলেও দূর করবে।’ তিনি বলেন, ‘সার্বিকভাবে মমতার জয়ে বাংলাদেশের খুশি হওয়ার কারণ রয়েছে এবং বিজেপিকে তা অনুধাবন করতে হবে। সেই দিক থেকে মোমেনের চিঠি গুরুত্বপূর্ণ।’

বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক শ্রীরাধা দত্তর মতে, ‘তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা সত্ত্বেও মমতাকে লেখা মোমেনের এই চিঠি কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উদাহরণ। ভারতের অঙ্গরাজ্য হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিই প্রধান বিবেচ্য। এর আধারে ভবিষ্যতে অমীমাংসিত ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা জিইয়ে রাখলেন।’

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
ফাইল ছবি: এএফপি

এবারের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস দুটি স্লোগান বড় করে তুলে ধরেছিল। ‘খেলা হবে ও ‘জয় বাংলা’। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ম-বর্ণ-জাতনির্বিশেষে বাঙালি শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মমতাও এই ভোটে সার্বিক বাঙালি জাত্যভিমানকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা ও লোকসভার সদস্য সৌগত রায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিনন্দন বার্তা সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃণমূলের রাজনীতি বরাবরের অসাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চিঠিতে তার উল্লেখ করেছেন। আমরা উৎসাহিত। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের সমর্থনে আমরা উদ্দীপ্ত।’