বিজয়ের মুহূর্তে রচিত গান 'বিজয় নিশান উড়ছে ঐ'

>

সুজেয় শ্যাম l ছবি: প্রথম আলো
সুজেয় শ্যাম l ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় মানুষের সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়েও। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা বিকেলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ঘোষণা করেন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এর পরপরই অজিত রায়ের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে রেডিওতে বেজে ওঠে একটি গান, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়া ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে’। বিজয়ের মুহূর্তে রচিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত শেষ গান ছিল এটি।

এই গানের সুরস্রষ্টা সুজেয় শ্যাম। এই গানের জন্মকাহিনি জানতে গত ২৮ নভেম্বর ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে গিয়ে হাজির হই তাঁর কাছে। ওখানে নতুন একটি দেশের গানের সুর তিনি তুলে দিচ্ছিলেন শিল্পী শাহীন সামাদকে। মহড়া শেষে কথা হয় সুজেয় শ্যামের সঙ্গে।

বিজয় দিবসের ওই বিশেষ দিনটির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সুজেয় শ্যাম বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সকাল। বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অফিসে গেছি। কিছুক্ষণ পরই আমাকে ডেকে পাঠালেন বেতারের দুই কর্মকর্তা আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান। তাঁরা বললেন, আজ অন্য
সব গান বাদ। আজ বিজয়ের গান করতে হবে। আমি বললাম, নতুন গান কোথায় পাব? তাঁরা বললেন, শহীদুল ইসলামকে বলেন, তিনি লিখে দেবেন।’

ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী তখনো আত্মসমপর্ণ করেনি। কিন্তু নির্দেশনা এসেছে বিজয়ের গান করার। সুজেয় শ্যাম তখন গীতিকার শহীদুল ইসলামকে বললেন দ্রুত গান লিখে দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে গানের স্থায়ীটুকু লিখে দিলেন তিনি।

স্মৃতিচারণায় সুজেয় শ্যাম বলেন, ‘গানের প্রথম চার লাইন পেলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, সুর করব কীভাবে। হারমোনিয়াম ভাগে পাওয়া যাচ্ছে না। মুখে মুখেই সুর করার চেষ্টা করলাম। অবশেষে হারমোনিয়াম পাওয়া গেল। এরপর অল্প সময়েই মুখটুকু সুর করে ফেললাম। শহীদুল ইসলাম অন্তরা দুটিও দ্রুত লিখে দিলেন।’

এই গানের শিল্পী ছিলেন কারা, জানতে চাই। ‘মুখটুকু সুর করার পর মনে হলো এটি শিল্পী অজিত রায় যদি নেতৃত্ব দেন, তাহলে ভালো হয়। তাঁকে গিয়ে বললাম, গানটি আপনাকে লিড দিতে হবে। তিনি রাজি হলেন। মহড়াকক্ষে তখন সমবেত কণ্ঠে গাওয়া এই গানের বাকি শিল্পীরাও উপস্থিত। রথীন্দ্রনাথ রায়, প্রবাল চৌধুরী, তিমির নন্দী, রফিকুল আলম, মান্না হক, মৃণাল কান্তি দাস, অনুপ ভট্টাচার্য, তপন মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, রূপা ফরহাদ, মালা খুররমসহ আরও অনেকে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে সুর, মহড়া সব শেষ। এরপর রেকর্ড করি।’

সেদিন এই গানে তবলা সংগত করেছিলেন অরুণ গোস্বামী, দোতারায় অবিনাশ শীল, বেহালায় সুবল দত্ত, গিটারে ছিলেন রুমু খান।

ওই দিন (১৬ ডিসেম্বর) বিকেলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে আসেন প্রবাসী সরকারের চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। তখনই উপস্থিত সবাই জানতে পারেন, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদারেরা আত্মসমর্পণ করেছে।

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত সুজেয় শ্যামের আরেকটি গান ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। গীতিকার আবুল কাশেম সন্দীপ। ওখানে এটা ছিল তাঁর সুরারোপিত তৃতীয় গান।

 ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানটির কাহিনি জানতে চাইলে সুজেয় শ্যাম পেছনে ফিরে যান, ‘কলকাতার বালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয় ২৫ মে ১৯৭১ সাল থেকে। আমি সংগীত পরিচালক হিসেবে সেখানে যুক্ত হই জুন মাসের মাঝামাঝি। এর আগে সেখানে বাজত আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফের পুরোনো গানগুলো। সমর দাস আর আমি যোগ দেবার পর আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল নতুন গান করার। তখন ১৫ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান প্রায় প্রতিদিন হতো। সেখানে দুটি পুরোনো গান আর একটি নতুন গান থাকত। একদিন স্টুডিওর দোতলা থেকে নামছি। সিঁড়িতে একজন ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে বললেন, “দাদা, আমি একটা গান লিখেছি। আপনি যদি সুর করতেন।” ভদ্রলোকের নাম আবুল কাশেম সন্দীপ। তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন “রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি” গানটি। প্রথম পড়েই গানের কথাটা আমার ভীষণ ভালো লাগল। তখনই হারমোনিয়াম নিয়ে সুর করতে বসে গেলাম। কিন্তু সুর মনঃপূত হয় না। বাড়ি গিয়ে গানটি নিয়ে আবার বসলাম। কিন্তু হলো না। দুদিন গেল। যেদিন রেকর্ডিং, সেদিন স্টুডিওর মহড়াকক্ষে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেই সুরটা এসে গেল। ১৫ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল এই গানটি। সমবেত কণ্ঠে গাওয়া গানটিতে সেদিন কণ্ঠ দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ রায়, প্রবাল চৌধুরী, তিমির নন্দী, রফিকুল আলম, মৃণাল কান্তি দাস, অনুপ ভট্টাচার্য, তপন মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, উমা খানসহ আরও অনেকে। এরপর এটি হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার গান।’

৭১ বছর বয়সী সুজেয় শ্যাম এমনভাবে স্মৃতিচারণা করছিলেন যেন ৪৫ বছর আগের নয়, এই সেদিনের ঘটনা। এখনো তিনি যেন ২৬ বছরের সেই তরুণ। এখনো অনবদ্য সব সুর সৃষ্টি করে যাচ্ছেন এই সুরস্রষ্টা।