বিতর্কিত ভাষ্যটি পরিমার্জন করেছে মন্ত্রণালয়

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পারিবারিক আইনের পরিবর্তনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছে।

রাশেদা কে চৌধূরী

নারীর প্রতি বৈষম্য নির্মূলের সনদ সিডওর দুটি ধারা সংরক্ষণ রাখার বিষয়ে সরকারের আগের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে সংরক্ষণের পক্ষে সরকারের বিতর্কিত ভাষ্যটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সিডও কমিটিতে জমা দেওয়া ২০১৫ সালের অষ্টম সাময়িক প্রতিবেদনে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে বাংলাদেশ জানিয়েছিল, ‘সমাজ এখনো পারিবারিক আইনের পরিবর্তন গ্রহণে প্রস্তুত নয়’এবং ‘পারিবারিক আইন পরিবর্তন করতে হলে সব ধর্মের নেতাদের সম্মতি প্রয়োজন’।

প্রতিবেদনের ওয়েবসাইট সংস্করণে ওই বাক্যগুলোতে পরিমার্জন এনে বলা হয়েছে, ‘সরকার প্রচলিত রীতিকে বিবেচনায় নিয়ে অসংগতিগুলো দূর করা এবং ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের পদক্ষেপগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সমাজকে প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তাকে সমর্থন করে।’

সরকারকে এখন সিডওর দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

এই পরিমার্জিত রূপটি রেখেই সিডও কমিটির জন্য নবম সাময়িক প্রতিবেদনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ওই কর্মকর্তারা বলেন, এই পরিবর্তন বলে দেয় আমরা বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছি এবং পারিবারিক আইনের পরিবর্তনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজ প্রস্তুত নয়’ সরকারের এই ভাষ্য নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছিল। সমাজ প্রস্তুত করার দায়িত্ব তো সরকারেরই। তিনি বলেন, নারীর পারিবারিক জীবন অর্থাৎ সম্পত্তি, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ইত্যাদিতে সমঅধিকার স্বীকৃতি না পেলে নারীর মানবাধিকার কখনো প্রতিষ্ঠা পাবে না।’

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই বছরই সিডও কমিটিকে নবম প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। বৈষম্য নিরসনের পদক্ষেপ জানিয়ে প্রতি চার বছর পরপর সিডও কমিটিকে প্রতিবেদন পাঠায় বিভিন্ন দেশের সরকার। তবে গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে সময় শিথিল করে সিডও কমিটি।

নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা নিয়ে আজ ৩ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও কার্যকরের ৪০ বছর আজ।

১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘে সিডও সনদ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এ সনদ কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিডও সনদ স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে। শুরুতে সনদের ২, ১৩ (ক), ১৬ (১) (গ) ও (চ) ধারার ওপর সংরক্ষণ রেখেছিল বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে ২ এবং ১৬ (১) (গ) ধারার ওপর সংরক্ষণ বহাল রেখে বাকি দুটি থেকে তুলে নেওয়া হয়।

বিতর্কিত ভাষ্য যেভাবে এল, বাদ গেল

সিডও সনদের ২ ধারায় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে আইনের সংস্কার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং ১৬ (১) (গ) ধারায় বিয়ে ও পারিবারিক আইনে সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ দুটি ধারা সংরক্ষণ রাখার পক্ষে আগে সরকারি ভাষ্য ছিল ‘বিষয়টি বিবেচনাধীন’। ২০১৫ সালে (২০১৬ সালে সিডও কমিটিতে পর্যবেক্ষণ হয়) সরকারের প্রতিবেদনে সংরক্ষণ প্রত্যাহার না করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, বিভিন্ন ধর্মীয় বিধান ও বিশ্বাসের আলোকে পারিবারিক আইন তৈরি করা হয়েছে। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনতে হলে সব ধর্মের নেতাদের সম্মতি প্রয়োজন। সমাজ এখনো এসব পরিবর্তন গ্রহণে প্রস্তুত নয় এবং সরকার রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে সতর্ক ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।

ওই সময় এই ভাষ্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা। ৫৩টি নারী ও মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডও, বাংলাদেশ ২০১৬ সালে সিডও কমিটিকে একটি ছায়া প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে সরকারের সমালোচনা করে বলা হয়, এর মাধ্যমে সরকার সংরক্ষণ প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে এসেছে। সংরক্ষণ প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপকে নতুন কারণ হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এর আগে কখনো বৈষম্যমূলক কোনো আইন পরিবর্তন ধর্মীয় নেতাদের সম্মতির ভিত্তিতে হয়নি।

গত বছর সিডও দিবস পালনের সময়ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সিডও প্রতিবেদনে বিতর্কিত ভাষ্যটি ছিল। এবার ওয়েবসাইটের ওই প্রতিবেদনে ভাষ্য পরিমার্জন করা হয়েছে।

খসড়া প্রতিবেদনেও ভাষ্য পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর হাতে এখনো খসড়া প্রতিবেদনটি আসেনি। তাই তিনি মন্তব্য করতে পারছেন না।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, সরকারকে এখন সিডওর দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে পরিবর্তনের কাজটি শুরু করতে হবে। সরকারকে এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে।