বিধিনিষেধের মধ্যে পড়ে বিড়ম্বনা

বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিয়ে গতকাল সকাল ছয়টায় কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর পর রাজধানীতে ঢোকা হাজারো মানুষের দুর্ভোগ।

কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনে ঢাকায় প্রবেশে পুলিশের বাধা। রাজধানীমুখী দূরপাল্লার গণপরিবহনগুলোকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার থেকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। যানবাহন না পেয়ে গন্তব্যে যেতে হেঁটেই রওনা হয়েছে মানুষজন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায়।
ছবি: আশরাফুল আলম

বরিশাল থেকে ছেড়ে আসা কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর সদরঘাট নৌ টার্মিনালের কাছাকাছি থাকতেই কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ঢুকে যায় দেশ। এই লঞ্চের যাত্রীদের একজন পোশাককর্মী মো. আরমান। সঙ্গে স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান ও ভাই। লঞ্চে এত বেশি ভিড় ছিল যে ব্যাগ-বস্তা নিয়ে টার্মিনালে নামতেই তাঁদের দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। আরমান তখনো জানতেন না তাঁদের সামনে কী বিড়ম্বনা অপেক্ষা করছে।

সদরঘাট থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় দেখা হয় আরমানের সঙ্গে। দীর্ঘ পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশের ফুটপাতে বসে ছিলেন তাঁরা। কষ্ট আর ক্ষোভ নিয়ে আরমান বললেন, ‘সকালে সদরঘাটে রিকশার অপেক্ষায় ছিলাম প্রায় এক ঘণ্টা। হাজার হাজার মানুষ, রিকশা অল্প কয়েকটা। গাবতলী পর্যন্ত দুই রিকশার ভাড়া চায় ১ হাজার ৬০০ টাকা। পরে হেঁটে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে পা আর চলছে না।’

পথে কয়েক দফা বিশ্রাম নিয়ে সাড়ে ১০টার দিকে গাবতলী পর্যন্ত পৌঁছান আরমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন সাভারের নবীনগরে। সেখানে তাঁর পরিচিত একজনকে ফোন করে একটি ভ্যান পাঠাতে বলেছেন। কিন্তু সেটি কখন আসবে, তা বুঝতে পারছেন না।

ঢাকা মহানগর পুলিশ আটক করেছে ৪০৩ জনকে। এ ছাড়া ২০৩ জনকে ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা জরিমানা। সারা দেশে র‌্যাবের ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ৯৫ জনকে ৪৮ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করেছেন।

আরমান যখন পরিবার নিয়ে ভ্যানের অপেক্ষায়, তখন রিকশা ভাড়া নিয়ে দরদাম করছিলেন সকালে বাসে বগুড়া থেকে ঢাকায় আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বখতিয়ার আলী। তিনি যাবেন পুরান ঢাকার বংশালে। বহু কষ্টে একজনকে ৬০০ টাকায় রাজি করাতে পারেন। তবে রিকশাচালক মো. রাসেলের দাবি, ভাড়া কম হয়ে গেছে।

রাজধানীর অন্যতম প্রবেশমুখ আবদুল্লাহপুরে গতকাল দুপুরে কথা হয় গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম এবং তাঁর বোনের ছেলে দিনমজুর নিক্সন মিয়ার সঙ্গে। তাঁদের বাড়ি ময়মনসিংহ সদরে। ঢাকায় মহাখালীর সাততলা বস্তিতে তাঁরা থাকেন। বাড়ি থেকে গতকাল সকালে অটোরিকশায় করে প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তায় আসেন তাঁরা। ওই অটোরিকশায় পাঁচজন যাত্রী ছিল। প্রত্যেককে ৫০০ টাকা করে ভাড়া গুনতে হয়েছে।

সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে টঙ্গী স্টেশন রোড পর্যন্ত আসতে তাঁদের দুজনের খরচ হয়েছে আরও ৪০০ টাকা। এরপর হেঁটে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত আসেন তাঁরা। আবদুল্লাহপুর থেকে মহাখালী যেতে ৫০০ টাকা রিকশা ভাড়া চাইছে। এত টাকা তাঁদের কাছে নেই। আবার হেঁটে মহাখালী পর্যন্ত আসবেন, শরীরে সে শক্তিও নেই। এ অবস্থায় তাঁরা কী করবেন, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।

সকালে সদরঘাটে রিকশার অপেক্ষায় ছিলাম প্রায় এক ঘণ্টা। হাজার হাজার মানুষ, রিকশা অল্প কয়েকটা। গাবতলী পর্যন্ত দুই রিকশার ভাড়া চায় ১ হাজার ৬০০ টাকা। পরে হেঁটে রওনা হই।
মো. আরমান, পোশাককর্মী, সদরঘাট থেকে গতকাল সকালে হেঁটে গাবতলী পর্যন্ত আসা

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ঢাকামুখী মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। এটি গতকাল সকাল পর্যন্ত ছিল। বিশেষ করে গতকাল সকালে যাঁরা ঢাকায় ঢুকেছেন, তাঁদের সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাত আটটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত ঢাকামুখী অংশে দীর্ঘ যানজট ছিল। সাইনবোর্ড থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। এর প্রভাবে ঢাকার প্রবেশমুখে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার এক কর্মী বলেন, ঈদের পরদিন এমন দীর্ঘ যানজট তিনি কখনো দেখেননি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় ঈদ উপলক্ষে আট দিন শিথিল থাকার পর গতকাল সকাল ছয়টা থেকে দেশজুড়ে আবারও শুরু হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। এই বিধিনিষেধ চলবে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত। এর আগে ১ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ১৪ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধ ছিল।

ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে গেলেন কতজন, ফিরেছেন কতজন

এবার ঈদের ছুটিতে কত মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন এবং ঈদের পরদিন ফিরে এসেছেন, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে। ঈদুল আজহার ছুটিতে ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা ছেড়ে যান প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী। এর বিপরীতে ২২ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিধিনিষেধ শুরুর আগের দিনে ঢাকায় ফিরেছেন ৮ লাখ ২০ হাজারের কিছু বেশি গ্রাহক। এর অর্থ বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকায় ফেরেননি অথবা ফিরতে পারেননি।

উল্লেখ্য, একজন গ্রাহকের একাধিক সিম থাকতে পারে। ফলে সিমসংখ্যা দিয়ে ঢাকা ছাড়া মানুষের প্রকৃত সংখ্যা বোঝা যায় না। তবে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর হিসাবে, দেশে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এর মধ্যে ‘ইউনিক ইউজার’ ৫৪ শতাংশ। মানে হলো, দেশে প্রকৃত মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটির কিছু বেশি। সে হিসাবে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সিম সংখ্যার ক্ষেত্রে ইউনিক ইউজারের হারটি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৫৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ । ফিরেছেন প্রায় ৪ লাখ ৪৩ হাজার। অবশ্য মুঠোফোন ব্যবহারকারী নন এমন ব্যক্তি ও শিশুরা এ হিসাবে নেই।

গতকাল সকালে গাবতলীতে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকায় ফেরা মানুষের যেন ঢল নেমেছে। যানবাহন না পেয়ে অনেকে হেঁটে, কেউ রিকশায় আবার কেউ ভ্যানে করে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চাপ কমে যায়। গাবতলীতে কথা হয় নড়াইলের কালিয়ার যুবক বিপ্লব ফকিরের সঙ্গে। তিনি শনিবারের ফ্লাইটে সৌদি আরব যাবেন। সাভারের আমিনবাজারের কাছে পুলিশ চেকপোস্টের আগেই বাস থেকে বিপ্লবসহ অন্য যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হেঁটে গাবতলী পর্যন্ত এসেছেন। কলাবাগানে যাওয়ার জন্য রিকশাচালক ৩৫০ টাকা ভাড়া চাইছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় নড়াইল থেকে বাসে রওনা দিয়েছি। আমিনবাজারে আসতেই সাড়ে ১০টা বেজে গেছে। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে অনেক যানজট ছিল।’

চার শতাধিক আটক, জরিমানা

সকালে ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে মানুষের চাপ থাকলেও দুপুরের পর প্রধান সড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। উত্তরা, গুলশান, বনানী, রামপুরা, মালিবাগ, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, মগবাজার, শাহবাগ, ফার্মগেট, তেজগাঁও, মহাখালী, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মূল সড়কে ব্যক্তিগত গাড়িও খুব কম চলেছে। বিভিন্ন চেকপোস্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে অনেককে। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদেরও বিভিন্ন এলাকায় টহল দিতে দেখা গেছে।

স্বাস্থ্যবিধি না মানা এবং বিধিনিষেধের মধ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় সারা দেশে র‌্যাবের ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল ৯৫ জনকে ৪৮ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করেছেন।

অন্যদিকে বিধিনিষেধের প্রথম দিনে সরকারি আদেশ অমান্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ৪০৩ জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত ২০৩ জনকে ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। এ ছাড়া ট্রাফিক বিভাগ ৪৪১টি যানবাহনকে ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিকের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনার বাইরে কোনো যানবাহনকে রাস্তায় চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা কঠোর অবস্থানে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছি। সরকারি নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’