বিশৃঙ্খল গণপরিবহন দেখার কেউ নেই

নির্দিষ্ট স্থানে না থামিয়ে প্রায় মাঝরাস্তা থেকে যাত্রী তুলছে একটি বাস। পেছন থেকে আরেকটি এসে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েছে। উদ্দেশ্য অভিন্ন। যাত্রীরাও বেপরোয়া। রাজধানীর শাহবাগে গতকাল বিকেল চারটার দৃশ্য।
নির্দিষ্ট স্থানে না থামিয়ে প্রায় মাঝরাস্তা থেকে যাত্রী তুলছে একটি বাস। পেছন থেকে আরেকটি এসে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েছে। উদ্দেশ্য অভিন্ন। যাত্রীরাও বেপরোয়া। রাজধানীর শাহবাগে গতকাল বিকেল চারটার দৃশ্য।

ঢাকায় বাস-মিনিবাসের অনুমোদন দেওয়া হয় কোনো রকম সমীক্ষা ছাড়া। চালক-মালিকেরা নির্ধারিত পথ ও স্টপেজ মেনে চলেন না। যাত্রী ওঠানো হয় অনেকটা টেনেহিঁচড়ে, নামানো হয় গলাধাক্কা দিয়ে। রাজনৈতিক মালিক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আর লাইসেন্সবিহীন চালক—এই হচ্ছে মোটা দাগে ঢাকার গণপরিবহন। 
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও মালিক-শ্রমিক সংগঠনের হিসাবে, ঢাকায় ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। অন্তত ৩০ শতাংশ বাসের চালকের লাইসেন্স নেই। বাস চলাচলের অনুমোদন আছে পৌনে দুই শ পথে। কিন্তু ১৫০টি পথের চালক-মালিকেরা নির্ধারিত পথ কিংবা স্টপেজ মানেন না।
ঢাকা ও এর আশপাশে বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি দেয় ঢাকা মহানগর পরিবহন কমিটি (মেট্রো আরটিসি)। কমিটির প্রধান মহানগর পুলিশ কমিশনার। ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি ও সরকারের আরও কয়েকটি সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছে ওই কমিটিতে। চলাচলের অনুমোদন বা রুট পারমিটের মূল শর্ত হচ্ছে মোটরযান আইন, নির্ধারিত স্টপেজ ও পথ মেনে বাস চালানো। এর কোনো একটার ব্যত্যয় হলে অনুমোদন বাতিল করার কথা আরটি সির। কিন্তু কিছুই করা হয় না। যেন দেখার কেউ নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার গণপরিবহন পরিকল্পনার দিক থেকে অবৈজ্ঞানিক। আর আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুবই বিশৃঙ্খল। ফলে এখানে যাত্রী আর পথচারীর প্রাণহানি স্বাভাবিক ব্যাপার। পরিকল্পনায় পুলিশসহ নয়টি সংস্থা কাজ করে। আর আইন প্রয়োগে আছে পুলিশ ও বিআরটিএ। সবার মধ্যে সমন্বয় না হলে ঝুঁকি কমানো যাবে না।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহনে যাত্রী নয়, মালিক-শ্রমিকেরাই প্রাধান্য পাচ্ছে। পথচারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে লাভ হবে না। আগে চালক-মালিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
পুলিশ, বিআরটিএ কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীরা জানান, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক মালিক-শ্রমিকনেতা ও পুলিশের ঘুষ-বাণিজ্য।
ওই সূত্রগুলো জানায়, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ ঢাকায় অন্তত ১৫ জন বর্তমান ও সাবেক সাংসদের পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মালিকানাধীন বাস ছাড়াও মতিঝিল-বালুঘাট পথের অনেক বাসের মালিক সাবেক সেনাসদস্য। হিউম্যান হলার, অটোরিকশা ও অনেক বাস-মিনিবাসের নেপথ্য মালিক পুলিশ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া সাংবাদিক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারাও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
সূত্র জানায়, ঢাকায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাস-মিনিবাস চলে। এগুলোর মালিক প্রায় দুই হাজার। প্রতি তিনটি বাসের জন্য একজন মালিক। একই কোম্পানিতে একাধিক মালিক থাকার কারণে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা হয়। আবার পেছনের বাস যাতে যেতে না পারে, এ জন্য বাসগুলো রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে তৈরি হয় যানজটের। অথচ প্রভাবশালীরা এর মালিক বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বাসের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলাও বাড়ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মোসলেহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ বসে নেই। ঢাকায় চাহিদা-জোগানের ফারাক অনেক। তাই পুলিশের আইন প্রয়োগের ফলে উন্নতিটা কম। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।’
টেনেহিঁচড়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর বিষয়ে যুগ্ম কমিশনার বলেন, সব স্থানে বাস দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কিন্তু যাত্রী আছে প্রচুর। পুলিশ ব্যবস্থা নিলে যাত্রীরা ভুগবে। আর পরিবহন চালকদের থামতে দিলে যানজট সৃষ্ট করে। আসলে সমস্যা দুই দিকেই। ফিটনেসবিহীন যান ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই মামলা করছি, যানবাহন জব্দ করছি।’
আনফিট গাড়ি ও চালক: এখনো সারা দেশে পৌনে দুই লাখের বেশি যানবাহন চলছে চলাচলের উপযোগী সনদ (ফিটনেস সনদ) ছাড়াই। গত ১০ নভেম্বর সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার পর গত ২০ দিনে প্রায় ৩৩ হাজার যানবাহন ফিটনেস সনদ নিয়েছে। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত অর্থে যতটা কারিগরি ও বাহ্যিক সঠিকতা যাচাই করে সনদ দেওয়ার নিয়ম, তা কোনোভাবেই মানা যাচ্ছে না। ১০ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৩ হাজার।
এদিকে, প্রায় সোয়া ছয় লাখ যানবাহন চলছে বৈধ লাইসেন্সধারী চালক ছাড়াই। সারা দেশে যানবাহন আছে প্রায় ২১ লাখ। আর বৈধ লাইসেন্সধারী চালক আছে ১৪ লাখ ৮২ হাজার। এ মধ্যে পেশাদার চালক আট লাখ ১১ হাজার। ফিটনেসবিহীন যান ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের একটা বড় অংশই ঢাকায় চলাচল করছে।
অনুমোদনের শর্ত মানে না কেউ: রোববার বেলা আড়াইটা। কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়ের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত। গুলিস্তান-মিরপুর পথের ইটিসি পরিবহনের একটি মিনিবাস এলেই অপেক্ষমাণ যাত্রীরা এতে ওঠার জন্য দৌড় শুরু করেন। একই সঙ্গে চলে নামাও। ঠিক সেই সময় গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পথের আরেকটি মিনিবাস বাঁ পাশ দিয়ে সজোরে আসতে থাকলে চাপা খাওয়ার ভয়ে ইটিসি পরিবহনে ওঠার চেষ্টারত যাত্রীরা সরে যান। একই সময় গুলিস্তান-আবদুল্লাহপুর পথের আরেকটি মিনিবাস ইটিসি পরিবহনের ডান দিক দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে থামে। একই সমান্তরালে কিছুটা আগ-পিছ হয়ে তিনটি মিনিবাসের অবস্থানের কারণে শুরু হয় পাল্লাপাল্লি। ফলে যাত্রীদের অনেকেই কাঙ্ক্ষিত বাসটিতে উঠতে পারেননি।
অনেকটা ধাক্কা খেয়ে নামা রাহাত হাসান বলেন, বাসে ওঠা বা নামার চেয়ে কঠিন কাজ বোধ হয় আর দ্বিতীয়টি নেই। পরিবহনশ্রমিকদের কাছে যাত্রীর জীবনের চেয়ে পাল্লাপাল্লিই বড়। মনে হয় তারা এটা খুব উপভোগ করে।
যে সার্ক ফোয়ারা মোড়ে তিন মিনিবাস একসঙ্গে থামানো হলো, সেখানে আসলে বাসের কোনো স্টপেজই নেই। বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি দেওয়ার সময় এর যাত্রার স্থান ও শেষ গন্তব্য ঠিক করে দেওয়া হয়। কোথায় কোথায় থামতে হবে, সেটাও উল্লেখ থাকে অনুমতির চিঠিতে।
পুরো ঢাকায় বাস থামার জন্য মাত্র ছয়টি স্থানে আলাদা লেন বা বাস বে আছে। এর মধ্যে ফার্মগেট অন্যতম। কিন্তু সেখানে অধিকাংশ বাস-মিনিবাসে যাত্রী ওঠানামা করানো হয় সড়কে। পুলিশ যানবাহন না থামানোর নির্দেশনা টানিয়েছে সেখানে। কিন্তু কেউ তা মানছে না।
এ-১৮৮ পথের (রুট) মিনিবাসগুলোর চলাচলের পথ নির্ধারিত আছে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ধলেশ্বর পর্যন্ত। পথে এসব মিনিবাস থামার কথা গাবতলী, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, ফার্মগেট, শাহবাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সায়েদাবাদে। কিন্তু এই বাসটি চলে গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত। পথে বাড়তি অন্তত ৮-১০ স্থানে যাত্রী ওঠানামা করায়।
সড়ক বা সিগন্যাল বাতিতে চালকের চোখ নেই: ‘ওস্তাদ পেছনে নাম্বার’—চালকের সহকারীর এই শব্দগুলো ঢাকার বাস-মিনিবাসে নিত্যদিন শোনা যায়। আসলে এখানে নাম্বার বলতে একই পথের অন্য বাসের আগমনকে বোঝায়। পেছনের বাসটি যাতে কোনোভাবেই আগে যেতে না পারে, সে জন্যই চালকের সহকারীর এই সতর্কবার্তা।
অধ্যাপক সামছুল হক তাঁর বিভিন্ন সময়ে করা গবেষণার কথা উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় বাসচালকদের চোখ সড়ক বা সংকেত বাতির দিকে থাকে না। রাস্তার যাত্রী আর লুকিং গ্লাসের মাধ্যমে পেছন দিক থেকে একই পথের অন্য বাস আসছে কি না, সেটাই দেখেন চালকেরা। যাত্রী তুলতে হবে আর পেছনের বাসকে আগে যেতে দেওয়া যাবে না—এ মানসিকতার কারণে সব সময় যাত্রী ও পথচারীরা ঝুঁকিতে থাকে।