বিচার বিভাগ পৃথককরণ-সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ প্রণীত শৃঙ্খলা বিধিমালা বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায়ই পূর্ণাঙ্গ আইন হিসেবে কার্যকর করা সম্ভব। সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করা একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সরকার কোনো কারণে গেজেট করতে না চাইলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নেওয়া সিদ্ধান্ত আপনা-আপনি কার্যকর হয় এবং আদালত তা কার্যকর করার এখতিয়ার রাখেন। আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তাঁরা আশা করেন যে সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের মূলনীতিকে সুরক্ষা দিতে বিধিমালাগুলো আগামী ১৫ জানুয়ারির আগেই গেজেট হিসেবে প্রকাশ করবে।
১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিচারকদের জন্য আলাদা শৃঙ্খলা বিধিমালা তৈরির নির্দেশনা দেন। ২০১৫ সালের মে মাসে সরকার বিধিমালার একটি খসড়া আপিল বিভাগে জমা দেয়। সুপ্রিম কোর্ট সেই খসড়ায় সন্তুষ্ট না হয়ে তা সংশোধন করে বিধিমালা চূড়ান্ত করে দেন এবং সরকারের প্রতি তা গেজেট আকারে প্রকাশের নির্দেশনা জারি করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ১১ ডিসেম্বর রোববার সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে রাষ্ট্রপতি ওই বিধিমালার গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন মনে করছেন না। সরকারের এই জবাব গ্রহণ না করে আপিল বিভাগের নয়জন বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ওই বিধিমালা আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে গেজেট প্রজ্ঞাপন হিসেবে জারির নির্দেশনা দেন। এই পটভূমিতেই দেশের শীর্ষস্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞরা প্রথম আলোর জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছেন যে সরকার গেজেট জারি না করলেও বিচারকদের ওই শৃঙ্খলা বিধিমালা আইন হিসেবে গণ্য হবে। সেই পটভূমিতে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার স্বার্থেই সরকারের তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা উচিত।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রফিক-উল হক মনে করেন, সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আওতায় আপিল বিভাগ তাঁর আগের আদেশে স্বাক্ষরকারী বিচারকদের সম্মতিতে তাঁর আদেশ সুয়োমোটো পরিবর্তন করতে পারেন। রাষ্ট্রপতিও অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে পরিবর্তন চাইলে আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন। আবার রাষ্ট্রপতি ১০৫ অনুচ্ছেদের আওতায় কোনো সাংবিধানিক প্রশ্ন সুরাহা করতে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠাতে পারেন।
এর আগে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগের রায়ে তা বাতিল হয়। কিন্তু তা কার্যকর করতে সংসদে কোনো বিল পাস বা কোনো ধরনের গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। ২০১০ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মামলায় জিয়াউর রহমানের সামরিক আইন বাতিল হলে সরকার শুধু আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান মুদ্রণ করেছিল। তখনো সেটা করতে রাষ্ট্রপতি কোনো ধরনের গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করেননি।
প্রথম আলোরঅনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রধান বিচারপতি সংবিধানে নির্দিষ্টভাবে দেওয়া ক্ষমতার আলোকেই বিচারকদের জন্য আচরণ বিধিমালা তৈরি করতে আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি শক্তিশালী কমিটি তৈরি করেন। এই কমিটির বৈশিষ্ট্য হলো এর সদস্যরা সবাই জেলা জজ থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন। এই কমিটিই আলোচিত শৃঙ্খলা বিধিমালা কার্যকর করতে আচরণবিধি তৈরি করেছে। সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের কর্মচারী সংক্রান্ত ১১৩ ও বিচারক সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদের অধীন দায়িত্বসমূহের ভার উক্ত আদালতের কোন একটি বিভাগকে কিংবা এক বা একাধিক বিচারককে অর্পণ করিতে পারিবেন।’ লক্ষণীয় যে ১১৩ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কর্মচারীদের জন্য বিধিমালা তৈরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদনের কথা বলা আছে। কিন্তু বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির পূর্ববর্তী বা পরে কোনো অনুমোদন দরকার পড়বে বলে উল্লেখ নেই। বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধিমালা তৈরির জন্য বিচারকদের কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতি বা সরকারের কোনো ভূমিকা সংবিধানে দেওয়া হয়নি।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘আমি মনে করি, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত করে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেটা কোনো ঐচ্ছিক নির্দেশনা নয়। বরং সেটা সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইতিমধ্যে দেশের প্রচলিত আইনে পরিণত হয়েছে।’
১১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হইবে।’ আবার সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আছে, ‘আইন’ অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।
২৮ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের নয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের ওপর ‘আদেশ’ জারি করেছেন।
রফিক-উল হক নিশ্চিত করেন যে ওই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আদেশ’-এর মধ্যে আপিল বিভাগের আদেশও আইন হিসেবে গণ্য হবে।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর-উল ইসলাম মাসদার হোসেন মামলায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃত। জানতে চাইলে তিনি বিচারপতি আবদুল মতিনের দেওয়া ওই অভিমতের সঙ্গে একমত হন। আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘বিধিমালা জারি করতে আপিল বিভাগের আদেশ প্রতিপালন করা আমি রাষ্ট্রপতির ওপর বলব না, তবে সরকারের ওপর বাধ্যকর।’ তিনি অবশ্য একই সঙ্গে উল্লেখ করেন যে ‘বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা প্রশ্নে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।’
উল্লেখ্য যে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান করবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকিবে।’
আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘শৃঙ্খলা বিধিমালার বিষয়টি ১০৯ অনুচ্ছেদের অন্তর্গত একটি বিষয়। আর সেখানে প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগ নয়, নির্দিষ্টভাবে হাইকোর্টকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। বিধিমালায় এর প্রতিফলন প্রত্যাশিত।’
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, হাইকোর্টকে যেহেতু ১০৯ অনুচ্ছেদে নিরঙ্কুশভাবে বিচারকদের তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাই বিধি-সংক্রান্ত ১০৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের বিষয়ে কোনো কথা বলা নেই। এই বিধানটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
আওয়ামী লীগ সরকারের দুই সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও আবদুল মতিন খসরু উভয়ে মনে করেন, সরকারের সামনে গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি না করার বিকল্প নেই। তবে শফিক আহমেদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, খসড়া বিধিমালা সম্পর্কে আপিল বিভাগের আদেশটি বর্তমানে যেভাবে আছে তাতে একটি নির্দেশনার ব্যাপার আছে। তবে আপিল বিভাগ দরকার মনে করলে বর্তমান নির্দেশনাকে বাধ্যতামূলক রায় হিসেবে গণ্য করতে পারবেন। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রস্তাবিত শৃঙ্খলা বিধিমালাকে আইনে পরিণত করতে পারবেন। একই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এ বিষয়ে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেখছি। যা থেকে পরে আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে পারি।’
প্রস্তাবিত শৃঙ্খলা বিধিমালাকে পূর্ণাঙ্গ আইনে পরিণত করার এখতিয়ার নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই বলেও মত দেন আবদুল মতিন খসরু। আরেকজন আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকও একই মত পোষণ করেন।
শাহদীন মালিক জোর দিয়ে বলেন, যদি একান্তই কোনো কারণে গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি না হয়, তার অর্থ এই হবে না যে আপিল বিভাগ তাঁর আদেশে যা চূড়ান্ত করেছেন তাকে কার্যকর করা যাবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। আর একে সুরক্ষা দিতে আপিল বিভাগের রায় ‘আইন’ বলেই গণ্য হবে।