বিশ্বজুড়ে বাংলাচর্চা

একুশে ফেব্রুয়ারি
ফাইল ছবি

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে দেশে-বিদেশে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বায়ান্ন-পূর্ব কালখণ্ডে, ঔপনিবেশিক আমলে বেশ কয়েকজন বিদেশি পণ্ডিত-গবেষক-লেখক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে লেখালেখি করে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম কেরি, হ্যানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স, লেবেদেফ, হ্যালহেড, গ্রিয়ারসন, ম্যাক্সমুলার, ম্যানুয়েল, ডিরোজিও, দুশান জাভিতেল প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। কেরি বাংলা গদ্যের বই লিখে খ্যাতি পেয়েছেন, গ্রিয়ারসন-ম্যাক্সমুলার ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, ম্যানুয়েল-হ্যালহেড লিখেছেন বাংলা ব্যাকরণগ্রন্থ, মৈমনসিংহ গীতিকা বিষয়ে দুশান লিখেছেন চমৎকার বই, আর ডিরোজিও-ম্যুলেন্স রচনা করেছেন কবিতা-উপন্যাস।

বিদেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) নাম। এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা অব্যাহত আছে। এ প্রতিষ্ঠানে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জন ভিক্টর বোল্টন, জন ক্লার্ক, উইলিয়াম রাদিচে প্রমুখ। তাঁদের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক গবেষক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বোল্টন ও ক্লার্ক বাংলা গদ্যসাহিত্য বিষয়ে কাজ করেছেন; রাদিচে অনুবাদ করেছেন মেঘনাদবধ কাব্য এবং গীতাঞ্জলি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার জন্য বিদেশের অন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা যায়, তার মধ্যে আছে শিকাগো, ইন্ডিয়ানা, মেলবোর্ন, হাইডেলবার্গ, প্যারিস, টরন্টো, অটোয়া, এডিনবার্গ, সরবোন, মস্কো, প্যাট্রিস লুমুম্বা, করাচি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। তবে সব কটির অবস্থা এক রকম নয়। কোনোটার অবস্থা আশাব্যঞ্জক, কোনোটা বা চলছে কোনোরকমে। শিক্ষার্থীর অভাবে কোথাও-বা বিভাগ বন্ধ হয়ে গেছে, যেমনটি ঘটেছে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাওয়ার্ড ডিমক এবং ক্লিনটন বি সিলির নাম বিদেশিদের বাংলাচর্চা প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য।

ডিমকের বইয়ের নাম লার্ন বেঙ্গলি। সিলি কাজ করেছেন জীবনানন্দকে নিয়ে, তাঁর বই আ পোয়েট অ্যাপার্ট জীবনানন্দ-গবেষক হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীন্দ্র মজুমদার এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিদেশে বাংলাচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পণ্ডিত-গবেষকদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান, রবীন্দ্রনাথ-অমর্ত্য-ইউনুসের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি, একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ—এসব ঘটনা ও অনুষঙ্গ বিদেশিদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে।

অমর একুশে


এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি পিকিং, প্রাগ, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ কার্যক্রম শুরু করেছে; টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিয়েশে নিওয়ার নেতৃত্বে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ পুনরায় চালু করার উদ্যোগের কথাও আমরা জেনেছি। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের বাংলা বিভাগ বিদেশে বাংলাচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই বিভাগে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ৪০ জন শিক্ষার্থী স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে এবং একাধিক ক্লাস করে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
২০০৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষদ বিদেশে বাংলাচর্চার ক্ষেত্রে আশাজাগানিয়া ভূমিকা পালন করছে। ইতিবাচক এবং সদর্থক চেতনা নিয়ে এই পরিষদ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারলে বিদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা ত্বরান্বিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতি-সংগঠন ‘বঙ্গীয়’র কথাও উল্লেখ করা যায়। বঙ্গীয় বিভিন্ন দেশে সম্মেলন আয়োজন করে বাংলাচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি আমাদের দেশের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে। বহু বিদেশি এখন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাবিধ কাজে বাংলাদেশে আসছেন এবং শিখছেন বাংলা ভাষা। এভাবেও বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ঐতিহাসিক উক্তি, ‘বাংলা ভাষার সূর্য এখন অস্তমিত হয় না।’


বিদেশি বাংলাচর্চার প্রতিষ্ঠান হিসেবে একসময়কার সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ননী ভৌমিক, হায়াৎ মামুদ, দ্বিজেন শর্মা প্রমুখ ব্যক্তির সহযোগে এই প্রতিষ্ঠান বিদেশে বাংলাচর্চার অনন্য এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বিদেশের অনেকগুলো বেতারে বাংলা ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠানের কথাও আমরা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি, স্মরণ করতে পারি বিদেশে প্রকাশিত অনেক বাংলা পত্রিকার নামও।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত পাঁচজন ভাষা শহীদের আবক্ষ ভাস্কর্য ‘মোদের গরব’
ফাইল ছবি


প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তিপর্যায়ে বেশ কয়েকজন পণ্ডিত-গবেষক-লেখক বিদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে রাশিয়ার দানিলচুক এবং মাদাম দিকোভা, জাপানের কাজুও আজুমা, ৎসুইয়োসি নারা এবং কিওকো নিওয়া, ইংল্যান্ডের জেমস কিথ, চীনের দং ইউ চেন এবং ম্যা লি উন, জার্মানির মার্টিন কেম্পশেন, হান্স হার্ডার, হানা রুথ টমসন প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। বহু দেশেই এখন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দসহ অনেক লেখকের রচনাবলি অনূদিত হচ্ছে। এসব উদ্যোগও বাংলা ভাষাচর্চার ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।


বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিদেশিদের আকৃষ্ট করছে, অনেকেই উৎসাহী হচ্ছেন বাংলাচর্চায়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং বাংলাদেশ সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতা বিদেশে বাংলাচর্চায় আনতে পারে সদর্থক গতিশীলতা।