বিয়েতে কাজির ফি লাগামছাড়া

বিয়ে পড়ানোর হাদিয়া, অফিস খরচ, নিকাহনামার বাংলা নকল, ইংরেজি নকল ও বিয়ে সনদের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়।

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর গুলশানের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সাদি ইসলামের বিয়ের তারিখ ঠিক হয় গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর। আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি শেষ করে বিয়ের নিবন্ধন খরচ জানতে ফোন করেন স্থানীয় কাজি অফিসে। তাঁকে জানানো হয়, ১০ লাখ টাকা দেনমোহরের বিয়েতে সব মিলিয়ে খরচ পড়বে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এই ফি বেশি মনে হওয়ায় তিনি পরে মহাখালীর কাজি অফিসে সরকার নির্ধারিত ফিতে বিয়ে নিবন্ধন করেন।

রাজধানী ঢাকায় বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থ আদায় করছেন। ঢাকার প্রায় ৩০ জন নিকাহ রেজিস্ট্রার ও কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে অনিয়মের এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে এ নিকাহ রেজিস্ট্রার ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন এই দুই প্রতিবেদক।

মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধন ২০১১)-এর ২১ বিধি অনুযায়ী, একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার টাকা দেনমোহর বা তার অংশবিশেষের জন্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে ‘বিবাহ নিবন্ধন ফি’ আদায় করতে পারবেন।

এই ফি বরপক্ষকে পরিশোধ করতে হয়। দেনমোহরের পরিমাণ ৪ লাখ টাকার বেশি হলে পরবর্তী প্রতি লাখ টাকা বা তার অংশবিশেষের জন্য ১০০ টাকা নিবন্ধন ফি আদায় করা যাবে। তবে দেনমোহরের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, সর্বনিম্ন ফি ২০০ টাকার কম হবে না। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিস্ট্রার যাতায়াত বাবদ প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১০ টাকা করে নিতে পারবেন।

বিয়ে নিবন্ধনের জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে তাঁরা সাধারণের কাছে ‘কাজি’ নামে পরিচিত।

২০০৯ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্সপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থীকে ১০ হাজার টাকা হারে ‘লাইসেন্স ফি’ দিতে হয়। একই বিধিমালায় সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডের জন্য একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারকে লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ আছে।

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে ঢাকা জেলায় ৫৮ হাজার ৬৬৪টি বিয়ে নিবন্ধিত হয়। ২০২০ সালে নিবন্ধিত হয় ৪২ হাজার ১২০টি বিয়ে। ঢাকা জেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বিয়ে নিবন্ধন ফি বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ২১ লাখ ৭৩ হাজার ১০০ টাকা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নিকাহ রেজিস্ট্রারকে বিবাহ নিবন্ধন ফি খাতে প্রতি অর্থবছরে ১০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।

নিকাহ রেজিস্ট্রাররা অনেক ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি টাকা আদায় করেন বলে সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনায়ও উঠে আসে। গত ২১ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি বলে, সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি টাকা আদায় করায় সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন।

কমিটির সদস্য রুমিন ফারহানা প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ ধরনের অভিযোগ আসছে। অনেক ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিস্ট্রাররা জোর করে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়কে নজরদারি বাড়াতে বলেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পাশাপাশি আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪-এর বিধান অনুযায়ী, প্রতিটি বিবাহ নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। এ উদ্দেশ্যে সরকার নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স দেয়। তাঁরা সরকারি বিধি মোতাবেক নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিবাহ ও বিচ্ছেদের নিবন্ধন করেন।

অফিস খরচ ও হাদিয়ার নামে অতিরিক্ত টাকা

তাসকিন আল আনাস গত জানুয়ারিতে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় বিয়ে নিবন্ধন করেন। দেনমোহর ছিল ছয় লাখ টাকা। সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী খরচ আসে ৫ হাজার ২০০ টাকা। তবে তাঁকে কাজিকে সব মিলিয়ে দিতে হয়েছে ৮ হাজার টাকা। তাসকিন বলেন, কাজি বলেছিলেন, তাঁর সহযোগী লোকজন আছেন। বেশি টাকা দিতে হবে।

গুলশানের কাজি আবদুল জলিল মিয়াজি সরকার নির্ধারিত বিয়ে নিবন্ধন ফির বাইরে বিয়ে পড়ানো বাবদ দুই হাজার টাকা নেন বলে জানালেন। একই সঙ্গে তিনি নিকাহনামার বাংলা-ইংরেজি নকল ও বিয়ে সনদ বাবদ পাঁচ হাজার টাকা নেন। বাসায় গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন করলে অতিরিক্ত এক হাজার টাকা নেন তিনি।

‘প্যাকেজ’ হিসেবে বাংলা নকল, ইংরেজি নকল, বিয়ের ইংরেজি সনদ, নোটারি সনদ বাবদ রাজধানীর নিকাহ রেজিস্ট্রাররা আড়াই হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।

উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের নিকাহ রেজিস্ট্রার আবু বকর সরকারি ফির বাইরে অফিস খরচ ও হাদিয়া বাবদ অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা নেন। সদরঘাটের নিকাহ রেজিস্ট্রার দেলোয়ার হোসেন অফিস খরচ বাবদ অতিরিক্ত এক হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। ফার্মগেটের নিকাহ রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ১০ লাখ টাকা দেনমোহরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা করে নেন তিনি। তবে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা যাবে।

ধানমন্ডির কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাজি অফিসে গত ডিসেম্বরে কথা হয় নিকাহ রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ শহীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারি নিবন্ধন ফির বাইরে তাঁরা অফিস খরচ হিসেবে ১ হাজার টাকা নেন। আর বিয়ে পড়ানোর জন্য তো হাদিয়া আছেই।

নিকাহ রেজিস্ট্রার তাঁর কাজে সহায়তার জন্য এক বা একাধিক সহকারী রাখেন। সহকারী থাকার অজুহাত দিয়ে কেউ কেউ অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন। তবে আইনে সহকারী রাখার বিষয়ে কিছু বলা নেই। বিয়ে নিবন্ধনের আইনগত এখতিয়ার শুধু লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিরই আছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা।

২০০৯ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্সপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থীকে ১০ হাজার টাকা হারে ‘লাইসেন্স ফি’ দিতে হয়। একই বিধিমালায় সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডের জন্য একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারকে লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ আছে।

ইংরেজির জন্য বিধি না থাকার ‘সুযোগ’

যাঁদের বিদেশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁরা নিকাহনামার বাংলা নকলের ইংরেজি করেন। একই সঙ্গে তাঁরা ইংরেজিতে বিয়ের সনদ ও নোটারি সনদ নেন।

নিকাহনামার বাংলা নকলের ইংরেজি অনুবাদকের মাধ্যমে করান নিকাহ রেজিস্ট্রাররা। ইংরেজিতে বিয়ের সনদ তাঁরা নিজস্ব ফরম্যাটে করে দেন। আর নোটারি করতে হয় নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে।

নিকাহনামার বাংলা নকলের ইংরেজি, ইংরেজি বিয়ের সনদ, নোটারি সনদ করার ক্ষেত্রে ফি কেমন হবে, তার উল্লেখ বিধিমালায় নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রাররা নিজেদের ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করেন। ‘প্যাকেজ’ হিসেবে বাংলা নকল, ইংরেজি নকল, বিয়ের ইংরেজি সনদ, নোটারি সনদ বাবদ রাজধানীর নিকাহ রেজিস্ট্রাররা আড়াই হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।

নিবন্ধন ছাড়া বিয়ে সমস্যার জন্ম দেয়

বাড়তি খরচ, অসচেতনতাসহ নানা কারণে, বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মধ্যে নিবন্ধন ছাড়া বিয়ের একটা প্রবণতা দেখা যায় বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা। তিনি বলেন, কেউ কেউ মাওলানা বা হুজুরের মাধ্যমে বিয়ে করেন। কাজির কাছে যান না, বিয়ে নিবন্ধন করেন না। একে অনিয়মিত বিয়ে বলা যায়। ধর্মীয় বিধান মেনে বিয়ের দিন থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে তা নিবন্ধনের কথা আইনে আছে। কাবিননামা বিয়ের একমাত্র লিখিত প্রামাণ্য দলিল। নিবন্ধন ছাড়া বিয়ে পরে নানা সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এতে বিশেষ করে নারীরা ভুক্তভোগী হন।