বিয়োগান্ত ঘটনার বিষণ্ন ছবি

‘হাসেম ফুডসে ঝলসানো প্রাণ’ শীর্ষক প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন দর্শক। গতকাল বিকেলে রাজধানীর দৃক গ্যালারিতে
ছবি: জাহিদুল করিম

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কান্নার শব্দ। চারপাশের কালো দেয়ালে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর তলায় জ্বলে ওঠা আগুনের রক্তিম শিখা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন নেভাতে প্রাণপণ চেষ্টা আর নিহত ব্যক্তিদের কফিন জড়িয়ে ধরে স্বজনহারাদের বুকফাটা বিলাপ। মানবিক বিপর্যয়ের ক্রমাগত ছবিগুলো হাসেম ফুডসের কারখানার সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের। রাজধানীর পান্থপথের দৃক গ্যালারিতে আলোকচিত্রীরা তুলে ধরেছেন এই মর্মস্পর্শী দৃশ্যমালা।

৪ সেপ্টেম্বর ৩২ বছর হলো দৃকের। সেদিন থেকেই ‘হাসেম ফুডস ঝলসানো প্রাণ’ নামের এই প্রদর্শনী শুরু, চলবে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের সেজান জুসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে গত ৮ জুলাই। আগুনের আলো আছে, উত্তাপ আছে—জীবনের জন্য তা খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু অব্যবস্থাপনা বা অসতর্কতায় সেই আগুন কতটা মর্মান্তিক পরিণতি ঘটায়, আবারও তার নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত তৈরি হলো হাসেম ফুডসের কারখানায়। কারখানার আগুন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিভিয়েছেন বটে, তবে আগুন নিভিয়ে দিয়েছে কারখানার ৫৪ জন শ্রমিকের প্রাণপ্রদীপ। সেই বিয়োগান্ত কাহিনিরই বিষাদময় উপস্থাপনা এই প্রদর্শনী।

দৃকের চার আলোকচিত্রী অগ্নিকাণ্ডের সময়ই ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবি ও ভিডিও দৃশ্য ধারণ করেছেন। পরেও উদ্ধার তৎপরতা ও মৃতদেহের সৎকারের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা। ছবি তুলেছেন ইশতিয়াক করিম, পারভেজ আহমদ, শহিদুল আলম ও সুমন পাল। পর্যায়ক্রমে দৃশ্যগুলো সাজানো হয়েছে প্রবেশের পর হাতের বাঁ পাশের দেয়াল থেকে। প্রথম থেকে দেখা যাচ্ছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে কারখানা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চেষ্টা করছেন আগুন নেভাতে। এরপর একটি সময়রেখা। এতে তুলে ধরা হয়েছে ১৯৯৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিকাণ্ড এবং দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খতিয়ান। তাতে দেখা যাচ্ছে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৯টি আর এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৯১৮ জন।

কান্নার শব্দ আসছিল প্রদর্শনীকক্ষের পূর্ব দিক থেকে। সেখানে একটু আলাদা করে লোহার জাল ও দেয়াল দিয়ে একটি স্থাপনার আয়োজন। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অগ্নিদগ্ধ কারখানার ভেতরে আদল। দেয়ালের মেঝে থেকে ছাদ অবধি ডিজিটাল প্রিন্ট। তাতে কারখানার পুড়ে যাওয়া দেয়াল, তাপে বেঁকে মুচড়ে যাওয়া ফ্যান, মেঝেতে পড়ে আছে পোড়া কাঠের টুকরো। এক পাশে একটি বড় মনিটরে চলছে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে ধারণ করা দৃশ্য। স্বজনহারাদের কান্না। আর্তনাদ। জ্বলতে থাকা আগুনের শব্দ। গায়ে উত্তাপ লাগে না, কিন্তু মনকে বিষণ্ন করে দেয় দুর্ঘটনার বাস্তবানুগ এই স্থাপনা।

এর পরে আছে লাশ উদ্ধার, অ্যাম্বুলেন্সে কফিন তোলা, আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর, জানাজা, হাসপাতালের বিছানায় দগ্ধদের যন্ত্রণাময় দিনযাপনের দৃশ্য। এক পাশে একটি মনিটরে আছে নিহত ৫৪ জনের ছবি। ছবির ওপর ক্লিক করলে প্রত্যেকের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। প্রদর্শনীটি অনলাইনেও দেওয়া আছে। scorchedlivesathashemfoods.com গিয়ে দেখা যাবে।

প্রদর্শনীর কিউরেটর এ এস এম রেজাউর রহমান জানালেন, ‘আর না’ এই নামে তাঁরা একটি ধারাবাহিক প্রদর্শনী করে আসছেন। সামাজিক বিভিন্ন অনাচার, অনিয়ম, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেই আহ্বান নিয়েই এই প্রদর্শনীগুলো করা। তারই ধারাবাহিকতায় হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে এবারের প্রদর্শনী। কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। প্রতিবার বলা হয় এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা আর হয় না।

কারখানায় যখন আগুন জ্বলছিল, তখন গেট ছিল তালাবদ্ধ। সেই তালাটির অনেক বড় একটি ছবিও আছে প্রদর্শনীতে। বিশাল এই তালা যেন বলে দিচ্ছে এখনো অনেক কিছুই তালাবদ্ধ আছে আমাদের সমাজে, মনে–মননে। তার অনিবার্য মুক্তি দরকার।