বীরকন্যার গ্রাম ধলঘাট

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মরণে তাঁর গ্রামের বাড়ির পুকুরপাড়ে তৈরি করা হয়েছিল স্মৃতিস্তম্ভ। সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

ধলঘাট, শান্ত–স্থির একটা জনপদ। গ্রামটির বুক চিরে পিচঢালা পথ চলে গেছে উপজেলা সদরের দিকে। নাম ‘প্রীতিলতা সড়ক’। প্রীতিলতা এই গ্রামের বীরকন্যা। জন্ম এখানে, জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভা দেবীর দ্বিতীয় সন্তান তিনি। ডাকনাম রানী। শৈশব কেটেছে গ্রামের ধুলোমাখা প্রান্তরে। তারপর চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কলকাতায় বিচরণ।

মৃত্যুর তিন মাস আগে প্রীতিলতা আবার ফিরেছিলেন জন্মস্থানে, ১৯৩২ সালের ১৩ জুন। বিপ্লবী সাবেত্রী দেবীর বাড়িতে প্রীতির প্রথম মাস্টারদা সূর্য সেন–দর্শন। সেদিনই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বেধেছিল ইংরেজদের সঙ্গে। দিনটি ‘ধলঘাট যুদ্ধ’ নামে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বীরকন্যা প্রীতিলতা স্মৃতিগ্রন্থে বর্ণিত আছে, ‘সাবেত্রী দেবীর বাড়িতে সন্ধ্যার পরেই পৌঁছে গেছেন প্রধান নেতা সূর্য সেন ও নির্মল সেন। প্রীতিলতাকে নিয়ে তারপর এসে পৌঁছায় তরুণ বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা সেন)। পাশের বাড়ির মালিক ছিলেন এক সরকারি ধামাধরা ভূস্বামী। তিনি পুরস্কারের লোভে ধলঘাট ক্যাম্পে খবর দেন—ওই বাড়িতে বিপ্লবীরা হয়তো এসেছে।’

যুদ্ধের স্মৃতি দর্শন শেষে পশ্চিমে ১০ মিনিট হেঁটে এগোলেই প্রীতিলতা সড়কের ওপর ক্যাম্প বাজার। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবতীর্থ ধলঘাটে ক্যাম্প করে ইংরেজ পুলিশ। আত্মগোপনে থাকা বিপ্লবীদের ধরতে রাতবিরাতে বিভিন্ন বাড়িতে হানা দিত তারা। এখানে এনে চলত নির্যাতন। পরে সেটি ক্যাম্প বাজার নামে পরিচিতি পায়। ক্যাম্পের কাঠামোটি নেই। বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডে কেবল নামটি লেখা আছে।

ক্যাম্প বাজারের উত্তরে প্রীতিলতার বাড়ি কয়েক মিনিটের পথ। বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে জীর্ণশীর্ণ একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে শেওলা জমেছে। ফাটল ধরেছে স্থানে স্থানে। চারদিকে ঘাস আর আগাছায় ভর্তি। পুকুরের অপর পাড়ে দেখা যায় প্রীতিলতার বাড়ির ভিটেটি। অর্পিত সম্পত্তি হয়ে যাওয়া ভিটেটিতে এখন বেড়ার ঘর করে থাকেন অরুণ দাশ নামের একজন। এখনো আরএস ও বিএস খতিয়ানে জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদারের নাম রয়েছে।

প্রীতিলতা

মালেকা বেগমের কীর্তিমান বাঙালি-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মেছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।... পরিবারের প্রথম ছেলেসন্তান মধুসূদনের পরেই প্রীতিলতার জন্ম। মেয়েসন্তান, তা–ও আবার গায়ের রং কালো। আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী সবাই মুখ কালো করলেন।’

সেই কালো মেয়ে আলো জ্বালিয়েছিলেন সারা ভারতবর্ষে। শেষবার জন্মস্থান থেকে ফেরার তিন মাসের মাথায় ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেন প্রীতি। সফল অপারেশন শেষে একটি গুলি এসে লাগে প্রীতিলতার গায়ে। পরে পটাশিয়াম সায়ানায়েড পানে আত্মাহুতি দেন ধলঘাটের এই বীরকন্যা।

স্বাধীনচেতা সাহসী সেই কন্যাকে কতটা চেনে ধলঘাট! একটু চেষ্টা করে চলছে এখানকার ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট’। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে ছয়তলা একটি ট্রাস্ট ভবন নির্মাণ করে দেয়। সেখানে ট্রাস্টের উদ্যোগে চালু হয় বীরকন্যা প্রীতিলতা শিশুকানন বিদ্যাপীঠ। এখন দরকার একটা বিপ্লবী স্মৃতি গ্যালারি ও গ্রন্থাগার।