বুমবুমও টাকা ফেরত দিচ্ছে না

সিআইডির নজরদারিতে থাকা ৩০টি প্রতিষ্ঠানের একটি বুমবুম। এদিকে ইভ্যালির বোর্ড গঠনে তিন জনের নাম দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

ই–কমার্স
প্রতীকী ছবি

গ্রাহকের টাকা আটকে রাখা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তালিকায় যুক্ত হলো আরেকটি নতুন নাম, বুমবুম শপিং। এ প্রতিষ্ঠান পাঁচ মাস আগে ব্যবসা শুরু করে পণ্যের দামে বিপুল ছাড়ের লোভ দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। দুই মাস ঠিকমতো গ্রাহকদের পণ্য দিয়েছে। তিন মাস ধরে তারা পণ্য বা টাকা—কোনোটাই দিচ্ছে না।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) যে ৩০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নজরদারিতে রেখেছে, তার একটি এই বুমবুম।

সিআইডির তালিকায় বুমবুমের নাম দেখে তাদের ওয়েবসাইটে একটি ঠিকানা পাওয়া যায়। রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ওই ঠিকানায় গিয়ে গতকাল বুধবার জানা যায়, বুমবুমের কার্যালয় সেখানে নেই। ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাসখানেক আগে বুমবুম কার্যালয় ছেড়ে দিয়েছে। তবে টাকা আটকে থাকা গ্রাহকেরা এখন এই ঠিকানায় এসে খোঁজ নিচ্ছেন।

অবশ্য পরে বুমবুম শপিংয়ের নামে চালানো একটি ফেসবুক পেজে গিয়ে আরেকটি ঠিকানা পাওয়া যায়। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকার বনানীর ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ উপস্থিত নেই। তবে তিনজন কর্মী রয়েছেন। একই সময় পাওনা টাকা ফেরতের জন্য গিয়েছিলেন চারজন গ্রাহক।

এই গ্রাহকদের একজন শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দুটি মোটরসাইকেল কেনার ফরমাশ (অর্ডার) দিয়েছিলেন। মোটরসাইকেল নিজে শরিকি যাত্রায় (রাইড শেয়ারিং) চালাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। আরেকটি বিক্রি করে দেওয়া ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সেটি মাস ছয়েক আগে চলে যায়। এরপর একজনের পরামর্শে মোটরসাইকেল কিনে চালানোর চিন্তা করেন। সে জন্যই বুমবুমে ফরমাশ দিয়েছিলেন।

শফিকুল ইসলাম ছাড়াও বুমবুমের সাত গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা সবাই বলেছেন, বুমবুম টাকা ফেরত দিচ্ছে না। কারও কারও টাকার পরিমাণ চার থেকে পাঁচ লাখ।

কার্যালয়ে উপস্থিত বুমবুমের কর্মকর্তাদের দাবি, তাঁরা চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের ৭৭ শতাংশের মতো ফরমাশের বিপরীতে পণ্য দেওয়া হয়েছে।

মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে বুমবুমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফজলে রাব্বি ভূঁইয়া প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, গ্রাহকের এক কোটির মতো টাকা অনলাইন লেনদেনব্যবস্থা বা পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে আছে। তাদের চারটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণেও গ্রাহকের পণ্য সরবরাহে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

অবশ্য ফজলে রাব্বি গ্রাহকের পাওনা মোট কত, ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আটকে আছে, পেমেন্ট গেটওয়েতে কত টাকা আছে—এসব বিষয়ে বলতে রাজি হননি। সিআইডি সূত্রের কাছ থেকেও বুমবুমের গ্রাহকেরা কত টাকা পাবেন, তা জানা যায়নি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পেমেন্ট গেটওয়ের বিরুদ্ধে যদি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে অভিযোগ থাকে, তাহলে টাকা আটকে থাকে। অভিযোগ না থাকলে আটকে থাকার কথা নয়। তবে কোম্পানি যদি গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ না করে, তাহলে পদ্ধতিগত কারণেই টাকা আটকে থাকতে পারে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ না করতে পেরে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখন টাকা আটকে থাকাকে অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছে।

পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের একটি বিকাশ। প্রতিষ্ঠান হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন শামসুদ্দিন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহককে পণ্য দেওয়া হলে টাকা আটকে থাকে না।

সিআইডি জানিয়েছে, তারা গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে ৬০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে ৩০টি নজরদারিতে রয়েছে। ১২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা তদন্ত করছে সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিট। অন্তত ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। চারটির বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রতারণা ও অর্থ পাচার মামলায় ৮টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক অথবা কর্মকর্তা মিলিয়ে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা এখন কারাগারে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গ্রাহকের বিপুল অঙ্কের টাকা আটকে আছে। এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের গ্রাহকেরা তাঁদের টাকা ফেরত চেয়ে মানববন্ধন করেছেন। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কিউকম কাস্টমারস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে গতকাল এ মানববন্ধন হয়। এর আগে গত সোমবারও টাকা ফেরতসহ সাত দাবিতে একই জায়গায় মানববন্ধন করেছিলেন কিউকমের গ্রাহকেরা। গতকালের মানববন্ধনে তাঁরা বলেন, কিউকমের পেমেন্ট গেটওয়ে ফোস্টার পেমেন্টসকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে রেখে তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়া হোক।

মানববন্ধনে গ্রাহকেরা প্রশ্ন তোলেন, একুশ শতকে ডিজিটাল সময়ে এসে কেন মানুষের টাকা আটকে থাকবে। সরকারের নজরদারির মধ্যে এমন ডিজিটালি প্রতারণা কেন হবে?

এদিকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আলোচনায় থাকা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় বোর্ড গঠনের লক্ষ্যে সাবেক তিন সচিবের নাম আদালতে প্রস্তাব করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল তিনজন অবসরপ্রাপ্ত সচিবের নাম দাখিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। তিন অবসরপ্রাপ্ত সচিব হলেন মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী (ভূমি মন্ত্রণালয়), মো. রেজাউল আহসান (স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগ) ও ইয়াকুব আলী পাটোয়ারী (চেয়ারম্যান, ভূমি সংস্কার বোর্ড)।