বেনাপোল-ভোমরায় বাণিজ্য দ্বিগুণ হবে

২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে। এই সেতু চালুর পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হবে। এতে দুই স্থলবন্দর বেনাপোল ও ভোমরা এবং দুই সমুদ্রবন্দর মোংলা ও পায়রা দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছে এসব বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন।

বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দরের অবকাঠামো সুবিধা দ্বিগুণ হচ্ছে। নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত পদ্মা সেতু। ২৫ জুন থেকে ফেরিতে পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে না, পদ্মার বুকে নির্মিত এই সেতু দিয়ে ছুটে চলবে যানবাহন। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ পার হওয়া যাবে মাত্র ছয় মিনিটেছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

পদ্মা সেতু যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের নতুন দ্বার খুলছে। সহজ যোগাযোগ ও সময় কমে আসায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এই সেতুর বড় প্রভাব পড়বে। যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করছেন আমদানি-রপ্তানিকারকেরা। এ লক্ষ্যে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দরের অবকাঠামো সুবিধা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

স্থলপথে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি হয় বেনাপোল দিয়ে। তারপরই অবস্থান সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের। পদ্মা সেতু চালু হলে এই দুটি স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সড়কপথে যাতায়াত সহজ হবে। সময় ও খরচ—দুটোই বাঁচবে। এতে দুই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুসারে, ভারতের সঙ্গে শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশের ৭০ শতাংশ আমদানি–রপ্তানি হয়।

পদ্মা সেতু চালুর পর মাওয়া পথে বেনাপোল থেকে ঢাকার দূরত্ব হবে ২২৫ কিলোমিটার। এখন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পথে ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব ২৬১ কিলোমিটার। অনেক সময় জরুরি পণ্য পরিবহনের সময় বেনাপোল বা মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু ঘুরে আসতে হয়, যাতে দূরত্ব পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পথের তুলনায় আরও ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেড়ে যায়। জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমদানির পণ্য বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে আনে। কারণ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট পার হতে পণ্যবাহী ট্রাককে অনেক সময় দু-তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ভারত থেকে পণ্য সরাসরি পদ্মা সেতু দিয়ে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরিবহন করা যাবে। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। যোগাযোগ সহজ ও দূরত্ব কমে এলে খরচও কমে আসবে।

বেনাপোল ও ভোমরার সক্ষমতা দ্বিগুণ হচ্ছে

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দিয়ে বেনাপোল, ভোমরা ও বুড়িমারী—এই তিনটি স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে ২ হাজার ৯০৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকও হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাঠানো হবে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাড়বে। বর্তমান সক্ষমতায় ওই দুটি বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালানো কঠিন হবে। বর্তমানে বেনাপোল বন্দরে দৈনিক ৩৭০টি পণ্যবাহী ট্রাক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় আরও এক হাজার ট্রাক ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। একইভাবে ভোমরায় আরও ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ পণ্যবাহী ট্রাক ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো হবে।

জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরে ৯০ বিঘা ও ভোমরায় ৬০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেখানে গুদামঘর, টার্মিনাল, আধুনিক কেমিক্যাল গুদাম, সেবা ভবন ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এসব কাজ শেষ করা হবে।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে কী পরিমাণ ট্রাফিক বাড়বে—তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা নেই। তবে আমরা ধারণা করছি, ভোমরা দিয়ে দ্বিগুণ পণ্যবাহী ট্রাক আসবে। বেনাপোলেও চাপ বাড়বে। এ কারণে এ দুটিসহ তিনটি স্থলবন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে নতুন স্থলবন্দর তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের স্থলবন্দরগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

দুই স্থলবন্দর দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ আমদানি-রপ্তানি

দেশে এখন ১২টি স্থলবন্দর কার্যকর আছে। এর মধ্যে বেনাপোল ও ভোমরা দিয়েই মোট আমদানি-রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ হয়। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ওই ১২টি স্থলবন্দর দিয়ে মোট ২ কোটি ২ লাখ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এর মধ্যে শুধু বেনাপোল ও ভোমরা দিয়ে ৬৬ লাখ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সদ্য সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর বেনাপোল দিয়ে আমদানি-রপ্তানি দ্বিগুণ হবে।

এ জন্য বেনাপোলের সুবিধা বাড়াতে হবে। এখন বেনাপোল থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকা আসতে গড়ে দুই দিনের বেশি সময় লাগে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট পার হতে ফেরির জন্য এক থেকে দেড় দিন বসে থাকতে হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে দিনে দিনেই পণ্যবাহী ট্রাক রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সক্ষমতার অভাবে বেনাপোল ও ভোমরা দিয়ে সব পণ্য আমদানি করা যায় না। তাই হিলি, সোনামসজিদসহ অন্যান্য বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর সময় ও পরিবহন খরচ সাশ্রয়ে ভোমরা ও বেনাপোলে চাপ বাড়বে। তাই দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিচ্ছে সরকার।