বৈদেশিক কর্মসংস্থানে বড় ধাক্কা

গত ৬ মাসে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ গেছেন সৌদি আরবে। নানা শর্তের চাপে সৌদি বাজারও এখন অনিশ্চয়তায়

দিনে ২ হাজারের বেশি। মাসে অন্তত ৬০ হাজার। দুমাস আগেও কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার চিত্র ছিল এমন। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বদলে গেছে পরিস্থিতি। বিধিনিষেধের চাপে কমে গেছে বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরবে যাওয়া। অন্য সব শ্রমবাজার কার্যত বন্ধ। এতে গত মাসের ৩১ দিনে বিদেশে গেছেন মাত্র ১৪ হাজার ২০০ কর্মী।

জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) দুজন কর্মকর্তা ও বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত তিনজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য। তাঁরা বলছেন, বড় শ্রমবাজারের মধ্যে আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, সিঙ্গাপুর বন্ধ হয়ে আছে। হাতে ছিল সৌদি আরব। উড়োজাহাজ সেবা নিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় এ বাজার নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। ভিসা করেও যেতে পারছেন না কয়েক হাজার কর্মী।

বিএমইটির কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারির প্রভাবে গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানো কমে যায় ৬৯ শতাংশ। গত ডিসেম্বর থেকে টানা চার মাস বাড়ার পর দুই মাস ধরে আবার কমছে বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা।

বিএমইটির তথ্য বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে এটি শুরু হলে ডিসেম্বর থেকে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। গত ৬ মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৮ জন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ গেছেন সৌদি আরবে।

দেশের স্বার্থেই কর্মী পাঠানো প্রয়োজন। তাই সরকার চাইলে ভর্তুকি দিতে পারে। এ ছাড়া দ্রুত টিকা দিতে প্রবাসীদের জন্য আলাদা কেন্দ্র করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিতে পারে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়
তাসনিম সিদ্দিকী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরু

ধাক্কার শুরুটা এপ্রিলে

দেশে নতুন করে করোনা বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল থেকে নানা বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এরপর ১৩ এপ্রিল রাত ১২টার পর থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সব ফ্লাইট বন্ধের কথা জানায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আটকে পড়েন হাজারো প্রবাসী কর্মী। এরপর ১৭ এপ্রিল থেকে বিশেষ ফ্লাইট চালু হয়। কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধের কারণে দূতাবাসে ভিসা প্রক্রিয়া, বিএমইটির স্মার্ট কার্ড বিতরণ বন্ধ থাকে বেশ কিছুদিন। এতে বিদেশে যাওয়ার গতি কমে যেতে থাকে।

নতুন বিধিনিষেধের চাপ

সৌদি আরবে গমনেচ্ছু কর্মীদের জন্য গত ২০ মে থেকে কিছু শর্ত আরোপ করে সে দেশের সরকার। এতে বলা হয়, করোনার পূর্ণ ডোজ টিকা না নেওয়া থাকলে ৭ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এ ছাড়া হোটেলে প্রবেশের আগে এবং কোয়ারেন্টিন শেষে বের হওয়ার পর করোনার জন্য নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে। এর ফলে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার বাড়তি খরচের বোঝা আসে কর্মীদের ঘাড়ে।

রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব ছাড়া সব শ্রমবাজার বর্তমানে বন্ধ আছে। সৌদি আরবে যেতেও খরচ বেড়ে গেছে। নতুন কর্মীরা বাড়তি খরচ করে যেতে রাজি হচ্ছেন না।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, সৌদিগামী পুরোনো প্রবাসী কর্মীদের ২৫ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দেবে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। তবে নতুন কর্মীরা এ ভর্তুকি পাচ্ছেন না। তাঁদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে মন্ত্রণালয়।

বাড়তি টাকা জোগাড়ের কষ্ট

কথা হয় শরীয়তপুরের আল আমিন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী হোসেনের সঙ্গে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে সৌদি আরবে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা। আলী হোসেন বলেন, অনেক কষ্টে এক ভাইয়ের মাধ্যমে সৌদির ভিসা করিয়েছেন। সৌদিতে গিয়ে ৭ দিন হোটেলে থাকার ব্যয় ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। একই বক্তব্য আল আমিনেরও। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনার দুর্যোগ কেটে গেলে বিদেশে কর্মী যাওয়া আবার বেড়ে যাবে। তবে সদ্য দায়িত্ব পাওয়া বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কল্যাণ তহবিল থেকে কর্মীদের জন্য যত বেশি সহায়তা আদায় করা যায়, সে চেষ্টা করবেন।

টিকিটের জন্য ভোগান্তি

২৭ মে কারওয়ান বাজার এলাকার সৌদিয়া এয়ারলাইনসের কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া গেল নাসিরুল ইসলামকে। এসেছেন কিশোরগঞ্জ থেকে। তিনি বলেন, আগেও দুই-তিনবার এসেছেন। আবার আজ তাঁকে আসতে বলা হয়েছিল। বাড়তি ৭০ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। রাতেই ফ্লাইট। এখন বুঝতে পারছেন না, কী করবেন! ১ জুন ফোনে আবার কথা হয় নাসিরুলের সঙ্গে। এবার তিনি বলেন, যেতে পারেননি এখনো। নতুন করে বাড়তি ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ১৭ জুনের টিকিট নিয়েছেন। ফ্লাইটের ৭২ ঘণ্টার আগে কোয়ারেন্টিন প্যাকেজ দিচ্ছে না সৌদিয়া। তাই অপেক্ষায় আছেন।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, ভোগান্তি কমাতে উড়োজাহাজ সংস্থা ছাড়াও ট্রাভেলস এজেন্সির কাছ থেকে কোয়ারেন্টিন প্যাকেজ নেওয়া যাবে। ৩০০ অনুমোদিত এজেন্সির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

টিকা নিলেই কমবে খরচ

দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর ১৪ দিন পার হলে সৌদিতে গিয়ে কোয়ারেন্টিন করতে হবে না কর্মীদের। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবাসী কর্মীদের টিকা নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এর আগে কোয়ারেন্টিনে প্যাকেজের জন্য সরকারের কাছে ভর্তুকি চান প্রবাসীরা। ভোগান্তি কমাতে কুইক রেসপন্স টিম গঠন করেছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। আর কোয়ারেন্টিন প্যাকেজের টাকা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে আদায়ের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের স্বার্থেই কর্মী পাঠানো প্রয়োজন। তাই সরকার চাইলে ভর্তুকি দিতে পারে। এ ছাড়া দ্রুত টিকা দিতে প্রবাসীদের জন্য আলাদা কেন্দ্র করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিতে পারে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।