ব্যবসা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় গুরুত্ব

২২ বছর পর দুই দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠকের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের নতুন পথনকশার দিকনির্দেশনা আসতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল মঙ্গলবার প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসছেন। বৈঠকে ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে পারে।

দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, দীর্ঘ ২২ বছর পর অনুষ্ঠেয় এই শীর্ষ বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের নতুন পথনকশার একটি দিকনির্দেশনা আসতে পারে। বৈঠকের পর প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে তিনটি দলিল সই হতে পারে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে সম্মতিপত্র এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত সপ্তাহে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

ঢাকা ও প্যারিসে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে আনুষ্ঠানিক সফর হিসেবে ঘোষণা করেছে ফরাসি সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর পাশাপাশি দেশটির প্রধানমন্ত্রী জঁ কাসতেক্সের বৈঠকটিও হবে আনুষ্ঠানিক। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লো দ্রিখাঁ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। আগামী বুধবার ফরাসি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

ইউনেসকোর সদর দপ্তর প্যারিসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার হস্তান্তর করবেন। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থায়নে এই পুরস্কার প্রবর্তন করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক সফরে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। তবে মাঝখানে তিনি বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে প্যারিস সফর করেন।

সইয়ের তালিকায় প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ে তিনটি সমঝোতা ও সম্মতিপত্র। জঙ্গি বিমান দাসল্ট রাফালে বিক্রিতে আগ্রহী ফ্রান্স। উড়োজাহাজ ও রাডার ব্যবসার প্রকল্পে আগ্রহী এয়ারবাস ও থালেস।

মরাস্ত্র বিক্রি ও প্রতিরক্ষায় মনোযোগ ফ্রান্সের

সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফোর্সেস গোল-২০৩০ কর্মসূচি নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্স কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে সমরাস্ত্র, বিশেষ করে জঙ্গি বিমান দাসল্ট রাফালে বিক্রির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোম সফরের পরের মাসেই ঢাকা সফরে আসেন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রাফালে কিনতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান। অন্যদিকে ইতালিসহ চার দেশ তাদের যৌথ উৎপাদিত জঙ্গি বিমান ইউরো ফাইটার বাংলাদেশে বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরের সময় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাফালে বিক্রির বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, দুই শীর্ষ নেতার আলোচনার পর সইয়ের তালিকায় থাকা সমঝোতা স্মারক ও সম্মতিপত্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টিও রয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার যে সম্মতিপত্র সইয়ের প্রস্তুতি চলছে, তা সামগ্রিক সহযোগিতাবিষয়ক। অর্থাৎ এতে প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহযোগিতা, প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো থাকছে। তবে ফ্রান্স শুধু জঙ্গি বিমান রাফালেই নয়, প্রশিক্ষণ বিমানও বাংলাদেশের কাছে বিক্রিতে আগ্রহী।

সুইডেনভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) ২০২১ সালের মার্চ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ ফ্রান্স। তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি দেশ যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।

এয়ারবাস, ই-ভিসা এবং এয়ার ট্রাফিক রাডারে আগ্রহ

ফ্রান্স সফরের সময় দেশটির শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেডেফের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এর পাশাপাশি বেসামরিক ও সামরিক উড়োজাহাজ এবং হেলিকপ্টার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের প্রধান নির্বাহী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন। সৌজন্য সাক্ষাতের তালিকায় আরও আছে রাডার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থালেস।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বেসামরিক উড়োজাহাজের পাশাপাশি ইউরোফাইটারসহ নানা ধরনের জঙ্গি বিমান ও সামরিক স্যাটেলাইট তৈরি করে এয়ারবাস। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বেসামরিক উড়োজাহাজের পাশাপাশি জঙ্গি বিমান বিক্রিতে আগ্রহী। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক রাডার সিস্টেম বিক্রি করতে চায় থালেস। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি ই-ভিসার কাজও পেতে চায়।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায়ের পর ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আমরা সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই। ফ্রান্সের দিক থেকে আমাদের ফোর্সেস গোল ২০৩০–কে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। তবে আমরা ব্যবসা, বিনিয়োগসহ সব বিষয়ে সহযোগিতা বাড়াতে চাই। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক কোথায় যাবে, তার একটি দিকনির্দেশনা থাকতে পারে।’