ব্র্যাকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ

বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের শিশুদের যাতায়াতসহ নানা সমস্যার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া ঠেকাতে ব্র্যাক চালু করে ভাসমান স্কুল ‘শিক্ষাতরি’

একজন ঐতিহাসিকের অনুসন্ধান থেকে দেখা যায় যে ১৯২১ সালে ভারতে খেতমজুরদের ৪৯ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে; এই হার ১৯৩১ সালে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৭৫ সালে আরেকজন গবেষক দেখাচ্ছেন যে ১৯৬৩-৬৪ সালে গ্রামীণ বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা ছিল ৯২ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ সালে এই হার দাঁড়ায় ৮৩ শতাংশে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় প্রকৃত অর্থে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। খাদ্য উৎপাদন প্রায় চার গুণ বেড়েছে। গড় আয়ুর প্রত্যাশা ১৯৭০ সালে ছিল ৪২ বছর। বর্তমানে এই হার দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৭ বছরে। দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের এই অসাধারণ অর্জনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের ভূমিকা। প্রথমত, ৯০ লাখের বেশি অদক্ষ শ্রমিক প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশের অদক্ষ এবং প্রধানত নারী শ্রমিকদের তৈরি করা পোশাকশিল্প থেকে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা নিয়ে প্রায় চার কোটি নতুন উদ্যোক্তা বাজারে প্রবেশ করেছেন। তৃতীয়ত, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই তিন ক্ষেত্রে রয়েছে স্যার ফজলে হাসান আবেদের নেতৃত্বে ব্র্যাকের অবদান।

১৯৮০ সালে ব্র্যাক ডায়রিয়া প্রতিষেধক কর্মসূচি (ওটেপ) চালু করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ডায়রিয়া রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ওরাল স্যালাইনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশে এ ধরনের রোগের ক্ষতিকর প্রভাব কমে আসে। এ ছাড়া ব্র্যাক ইউনিভার্সাল চাইল্ড ইমিউনাইজেশন প্রকল্পে অংশ নিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণেও তারা এগিয়ে আসে। স্বাস্থ্যসেবিকাদের মাধ্যমে জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়। এসব কর্মসূচির সাফল্যের ফলেই জনসাধারণ অনেক ক্ষেত্রে রোগবালাইয়ের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ শ্রমবাজারে তাঁদের অবদান রাখতে সক্ষম হন। আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে, আফ্রিকায় এইডস মহামারি রোগ প্রতিরোধে এই মহাদেশের বিভিন্ন দেশ অক্ষম হওয়ায় তাদের শ্রমশক্তির অবদান কমে যায়, অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রচলিত মহামারি রোধে সক্ষম হওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকেরা অনেক বেশি অবদান রাখতে পারেন। প্রতিষেধকব্যবস্থা বিস্তারে ব্র্যাকের ব্যাপক সাফল্যের পেছনে রয়েছে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অনেক উদ্ভাবনমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হয়েছে।

ব্র্যাক স্কুলে শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ

বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রেও আবেদের নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। উপ–আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্র্যাকের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার হ্রাস করার কোনো সহজ সমাধান ছিল না। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এই শিক্ষাব্যবস্থায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা আদৌ বিবেচনায় নেওয়া হতো না। উপরন্তু এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই নিরানন্দ।

বাংলাদেশে প্রথম কে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করেন, সে সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু ব্র্যাক যে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করেছে, সেটি নিঃসন্দেহে একটি সফল প্রকল্প। ব্র্যাকের ঋণ কর্মসূচির কিছু ব্যতিক্রমধর্মী দিক রয়েছে। এ প্রকল্পে শুধু ঋণই দেওয়া হয় না, ঋণগ্রহীতাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। হতদরিদ্রদের জন্য বিশেষ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি সাফল্য অর্জন করেছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের মধ্যে শুধু ঋণ বিতরণই করা হয়নি, তাঁদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও প্রসারিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের একটি বড় সমস্যা হলো, এখানে দরিদ্রবান্ধব ব্যবসায়ের উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। দরিদ্রদের জন্য যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেগুলো বেশির ভাগই লোকসান করে। দরিদ্রদের পণ্য প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজারজাত করা সম্ভব হয় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবেদ বাংলাদেশে ১৬টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যারা দরিদ্রদের পণ্য বাজারজাতকরণে সহায়তা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো আড়ং, যা এ দেশের হতদরিদ্র নারীদের পণ্য দেশে ও বিদেশে ন্যায্যমূল্যে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করেছে। এসব সেবা ও পণ্য দেশের ১১ কোটির বেশি মানুষের নানা চাহিদা মেটাচ্ছে। এ ছাড়া বীজ, মৎস্য, কৃত্রিম প্রজনন, ব্র্যাক চিকেন, দুগ্ধ, মুদ্রণ, ব্যাংকিং প্রভৃতি খাতে এখন এত সফল হয়েছে যে এদের লাভের অর্থ দিয়েই ব্র্যাকের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজের অর্থায়ন হচ্ছে। সম্পদের জন্য ব্র্যাক শুধু বাইরের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল নয়। দরিদ্রদের স্বার্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্জিত মুনাফায় দরিদ্রদের জন্য কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ব্র্যাকের কর্মসূচিগুলো দরিদ্রদের উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।

এ ধরনের উপলব্ধি থেকে ব্র্যাকের কর্মসূচিতে উপ–আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচিকে একদিকে শিক্ষার্থীদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থা যাতে উৎপাদন ব্যাহত না করে, তার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই উপ–আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা সারা দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ ধরনের ৩৪ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম খরচে দরিদ্র মানুষের সন্তানদের শিক্ষাজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। তবে এ কর্মসূচি এখানেই থেমে নেই, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যও প্রয়াস চালাচ্ছে।

উন্নয়নশীল দেশসমূহে অর্থনীতির একটি বড় সমস্যা হলো, নারীদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে অবদান সীমিত। বাংলাদেশে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা অপসারণ বেসরকারি সংস্থাসমূহের একটি বড় অবদান। দক্ষিণ এশিয়ার চিরাচরিত সমাজব্যবস্থায় নারীদের পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। মনুসংহিতায় বিধান দেওয়া হয়েছে যে কোনো শিশুকন্যা বা তরুণী এমনকি কোনো বৃদ্ধ নারী নিজের বাড়িতেও তাঁর ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারবেন না। শৈশবে নারী পিতার নিয়ন্ত্রণে থাকবেন, যৌবনে থাকবেন স্বামীর নিয়ন্ত্রণে এবং স্বামী মারা গেলে থাকবেন ছেলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। কোনো অবস্থাতেই নারী নিজেকে তাঁর পিতা, স্বামী বা ছেলে থেকে আলাদা কিছু করার উদ্যোগ নিতে পারবেন না। যদিও পশ্চিমা জগতে এ ধরনের বিধান নেই, পাশ্চাত্যে অর্থশাস্ত্র নারীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাঁরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখেন, কিন্তু পারিবারিকভাবে যে কাজ করেন, তার কোনো স্বীকৃতি অর্থশাস্ত্রে নেই। যদি কোনো নারী চাকরানী হিসেবে কাজ করেন, তাহলে তাঁর আয় জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই নারীই যদি বাড়ির কর্তাকে বিয়ে করেন, আরও অনেক বেশি কাজ করেন, তাঁর অবদান অর্থনীতির হিসাবে যোগ হয় না। ফলে অর্থনীতির হিসাবে জাতীয় আয় কমে যাবে, যদিও বাস্তবে জাতীয় আয় বেড়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, চাকরানীদের বিয়ে করলে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি হবে, অর্থাৎ জাতীয় আয় কমে যাবে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য নিরসনে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। অবশ্য এই কাজ প্রথমে পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। দারিদ্র্য নিরসন করতে গিয়ে দেখা যায়, যেসব কর্মসূচিতে নারীরা অংশগ্রহণ করেছেন, সেসব কর্মসূচি সবচেয়ে বেশি সফল।

আবেদ লিখেছেন, তিনি গ্রামীণ নারীদের দায়িত্বশীলতায় মুগ্ধ হয়ে নারী কর্মসূচির দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের নারীরা যে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, সে ধরনের কাজ বাংলাদেশের পুরুষেরা করতে পারেন না। বাংলাদেশের বড়লোক পুরুষেরা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন, অথচ তার অধিকাংশই ফেরত দেন না। দরিদ্র নারীরা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে যে ঋণ নেন, তার প্রায় ৯৯ শতাংশ সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করেন।

স্যার আবেদের ব্র্যাক বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম এনজিও। ব্র্যাকের একটি বড় বিশেষত্ব হলো, ব্র্যাক নীলনকশার প্রতিষ্ঠান নয়, যারা আগে থেকে সব পরিকল্পনা তৈরি করে, ওই পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ করে। এদের পক্ষে নীলনকশার কোনো পরিবর্তন মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। ব্র্যাক নীলনকশার প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে তারা প্রকল্প বাস্তবায়নকালে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং প্রকল্পে পরিবর্তন করে। শিক্ষারত প্রতিষ্ঠান হওয়ার ফলে ব্র্যাকের পক্ষে নানা দুর্যোগ অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে।

ড. আকবর আলি খান, সাবেক আমলা, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ