ব্লক রেইড মানে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

‘রাত পৌনে দুইটা। সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। অজানা আশঙ্কায় দরজা খুলতেই দেখি দরজার সামনে পুলিশের ১০-১২ জন সদস্য, সবার হাতে অস্ত্র। সেই অস্ত্র তাক করে সবাইকে বললেন, “হ্যান্ডস আপ”। এরপর নানা প্রশ্ন, ঘরের প্রতিটি কোনায় কোনায় তল্লাশি।’ মোহাম্মদপুরের নতুন আবাসিক এলাকা নবোদয় হাউজিংয়ে পুলিশের ‘ব্লক রেইড’-এর এই ভীতিকর পরিস্থিতি তুলে ধরেন এক বাসিন্দা। গত বুধবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অভিযানে পুলিশ কিছুই পায়নি। কিন্তু আমরা ভয়ে কাঁপছিলাম। গত ২৭ জুলাই প্রথম প্রহরে ব্লক রেইড শুরু হয়। আর শেষ হয় ভোরে।’
অপরাধী আটক করতে কোনো এলাকা ঘেরাও করে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানোকে পুলিশের ভাষায় ব্লক রেইড বলে।
গুলশানে জঙ্গি হামলার পর গত ২০ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ রকম অন্তত ৬০টি ব্লক রেইড চালিয়েছে পুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসিন্দারা এক ভীতিকর তল্লাশি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
১ জুলাই গুলশানে রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর থেকে এসব তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে। এর মধ্যে খিলগাঁও, হাজারীবাগ, জুরাইন, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর, সূত্রাপুর ও উত্তরা পশ্চিম এলাকয় সাতটি তল্লাশিতে ৪৬ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্যগুলোতে সন্দেহভাজন কাউকে পায়নি পুলিশ। আটকদের মধ্যে ৩৪ জন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ৬ জনকে মাদকসহ আটক করা হয়। নিয়মিত মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় বাকি ৬ জনকে। গত বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৪৯টি থানায় কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযানের সময় বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন এমন একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানের ধরন দেখে তাঁদের মনে হয়েছে যে কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াই পুলিশ ঢালাওভাবে অভিযানে নেমেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে অভিযান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরাও শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, এমন অভিযানের সময় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থাকলে ভালো হয়। তাতে বাড়াবাড়ির সম্ভাবনা কম থাকে। তবে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে ‘অফেনসিভ ওয়েতে’ অভিযান না চালিয়ে উপায় থাকে না।
মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের আটক করতে রাজধানীর সন্দেহভাজন মেস ও বাড়িতে ব্লক রেইড চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ৪৯টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের লিখিত নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার। এরপর থেকে ডিএমপির বিভিন্ন থানার নির্দিষ্ট এলাকা ধরে ব্লক রেইড শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে গত ২৫ জুলাই রাতে কল্যাণপুরে ব্লক রেইড দেয় পুলিশ। এতে একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। পরদিন সকালে পুলিশের বিষেশায়িত বাহিনী সোয়াট ওই বাড়িতে অভিযান চালায়। এতে ৯ জন জঙ্গি নিহত হয়। আহত অবস্থায় আটক হয় একজন।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহম্মদ বলেন, গুলশানে হামলার আগেও ব্লক রেইডের নির্দেশনা ছিল। ঈদের পর ডিএমপি কমিশনার আবারও ব্লক রেইড জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ডিএমপির সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড চালানো হচ্ছে। ব্লক রেইডের সময় বড় একটি এলাকা ঘেরাও করে পুলিশ অভিযান চালায়। এতে সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা হয় আটক হয়, নয়তো ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ব্লক রেইডের সময় পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সঙ্গে থাকেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযানের কারণেই কল্যাণপুরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া খিলগাঁও ও হাজারীবাগ থেকে শিবিরের ৩৩ জন নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ব্লক রেইড হয়েছে বিভিন্ন বস্তি, মেস ও কম টাকায় ভাড়া পাওয়া যায় এমন বাড়িতে। গত মঙ্গলবার রাতেও কদমতলীর জুরাইন, পশ্চিম ধানমন্ডি, আবাহনী মাঠের আশপাশ, নাখালপাড়া, মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলোনি, শ্যামলী এলাকায় এ ধরনের তল্লাশি চালানো হয়েছে।
কলাবাগানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন ১১ বন্ধু। সবাই ব্যাচেলর। এঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহ খানেক আগে তাঁদের এলাকায় পুলিশ তল্লাশি অভিযান চালায়। মধ্যরাতে বাসায় ঢুকে পুলিশ সদস্যরা ফ্ল্যাটের সবার ঘুম ভাঙিয়ে নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করেছেন। তিনি বলেন, ঘরে জুতার বাক্স থেকে শুরু করে ল্যাপটপে পর্যন্ত তল্লাশি চালানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কিছু পায়নি। মেসের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন।
ডিএমপির রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন সাগর প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন কলাবাগানের অভিযানে পুলিশের প্রায় ৩০০ সদস্য অংশ নিয়েছিলেন। সব বাড়িতে ঢুকে লোকজনকে জাগিয়ে তল্লাশি চালাতে অনেক সময় লাগে। তাই কলাবাগানের কিছু এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।’ পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কেউ যাতে অকারণে হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।
পশ্চিম ধানমন্ডির আরেক বাসিন্দা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মঙ্গলবার রাতে পুলিশ তাঁর নাম-পরিচয় জেনে চলে গেলেও পাশের বাসার বাসিন্দা এক গাড়িচালকের দিকে অস্ত্র তাক করে জেরা করেছে। এ সময় ভয়ে ওই গাড়িচালক কাঁপছিলেন। অনেকক্ষণ তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি।
খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী মইনুল ইসলাম বলেন, তাঁর এলাকায় এখন পর্যন্ত ছোট-বড় ৮-১০টি ব্লক রেইড হয়েছে। পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চলছে। তিনি বলেন, গত ১৯ জুলাই ‘এ’ ব্লকের একটি বাসায় তল্লাশি হয়। এ সময় শিবিরের ১৯ নেতা-কর্মীকে আটকের পাশাপাশি তাঁদের কাছ থেকে প্রচুরসংখ্যক উগ্র ধর্মীয় মতবাদের বই উদ্ধার করা হয়।
জানতে চাইলে আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পরোয়ানা ছাড়া শুধু সন্দেহ করে এভাবে তল্লাশি চালানো অনুচিত। যেহেতু বেশির ভাগ তল্লাশিতে কিছু পাচ্ছে না, তাতে মনে হচ্ছে পুলিশের তথ্য ঠিক ছিল না। এ ক্ষেত্রে দরকার সঠিক তথ্য নিয়ে অভিযান চালানো। তা করা হলে মানুষও পুলিশকে তথ্য দিতে এগিয়ে আসবে। তা না হলে পুলিশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।