ভরসা রাখি তারুণ্যে

শ্রীমতী সাহা

নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও লক্ষ্যে অবিচল তিনি। কাজ করে চলেছেন নিরলস। মানুষের পাশে থেকে তাদের আত্মনির্ভর করে তোলার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর কর্মযজ্ঞ তরুণদের প্রেরণার নিরন্তর উৎস। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের পরিচালক শ্রীমতী সাহার প্রতীয়মান হয়েছে জীবনের নানা ইতিবাচক দিক, আশাবাদী হয়েছেন তরুণদের নিয়ে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেখা আপনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন কী কী?

শ্রীমতী সাহা: আমাদের বর্তমান সমাজ তো পরিবর্তনেরই ফল। যাপন, শিক্ষা, পেশা, সামাজিক সম্পর্ক—সবকিছুতেই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে সমাজসেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে।
‘সমাজসেবা’ শব্দটির মধ্যেই একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এখন বলা হচ্ছে সমাজকর্ম। আগে আমরা দেখেছি বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিরাই নানাভাবে সমাজসেবা করে গেছেন। যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন, জলের অভাব পূরণ করতে পুকুর খনন করেছেন ইত্যাদি।
এখন কিন্তু যার অর্থ নেই, সেও কিছু সমাজসেবা করছে। সমাজকর্মকে পেশা বলা হচ্ছে। এর আবার মূল্যবোধ আছে। শিক্ষকতা, স্বাস্থ্যসেবা, মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়া, বিশেষ করে মেয়েদের আর্থসামাজিক স্বাধীনতায় এগিয়ে আসা সংগঠনগুলোর কাজ চোখে পড়ার মতো। আগে যেমন দেখেছি, মেয়েরা সংসারে অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে, এখন তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া সমাজসেবার মধ্যেই পড়ছে। এসব পরিবর্তন দেখে ভালো লাগছে।

প্রশ্ন:

তরুণদের প্রতি প্রত্যাশা

শ্রীমতী সাহা: যুগে যুগে তরুণদের ওপরেই ভরসা করে এসেছে সমাজ। তরুণেরাই যেকোনো জাতির আত্মা। সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিবর্তনের কারিগর। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি, নানাভাবে তরুণেরাই এগিয়ে এসেছে যোদ্ধা হিসেবে। যেকোনো আপৎকালীন সময়ে তরুণদেরই দেখি সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আজকের বাংলাদেশে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, সমাজ—সবক্ষেত্রেই তরুণেরা বিপ্লব এনেছে। কোনো কাজকেই তারা ছোট করে দেখে না। আমাদের দেশটাকে গড়তে যা কিছু প্রয়োজন, সেটি তারা করবে। অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াবে, সাফল্যকে অভিনন্দন জানাবে। তরুণ দলই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুলবে—এটাই প্রত্যাশা। আমি অত্যন্ত আশাবাদী।

প্রশ্ন:

এই সময়ে তরুণদের প্রতি আপনার পরামর্শ

শ্রীমতী সাহা: শুধু প্রত্যাশা করলেই তো হবে না, তরুণদের গড়ে তুলতে আমাদেরই সচেতন হতে হবে। প্রতিটি পরিবারের খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন বিপথে না যায়। তরুণদের উচিত বড়দের পথনির্দেশনা শোনা। মাদককে ‘না’ বলতে শিখতে হবে কঠিনভাবে। নীতিবোধ, মূল্যবোধ, দেশাত্মবোধ সব সময় সমুন্নত রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। সব সময় ভালো কাজের সঙ্গী হবে।

প্রশ্ন:

‘নারী’ বলে কোনো বাধা এসেছে কি?

শ্রীমতী সাহা: আমি এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি এবং যে পরিবারে আমার বিয়ে হয়েছে, সেখানে নারী-পুরুষের পার্থক্য করা হয়নি কখনো। এ আমার সৌভাগ্য। আমার বিয়ে হয়েছে কুমুদিনী পরিবারে অল্প বয়সে। এখানে এসে পেয়েছি এক বিশাল সংসার, পেয়েছি শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, ননদদের। সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কখনো আমাকে বিব্রত করা হয়নি। বিয়ের পর পড়াশোনা করেছি স্বাধীনভাবে। যদিও আমি নিজেই একটু ঘরমুখী; এই পরিবারের মেয়েরা সেই ত্রিশের দশক থেকেই পড়াশোনা করা, সু পরা, ঘোড়ায় চড়া, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত ছিল। আমাকেও উৎসাহিত করত। আমার শ্বশুর সমাজসেবক দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা প্রথম জীবনে ব্রিটিশ আর্মিতে ছিলেন।
সৈনিক জীবনের শিক্ষা যে তাঁর অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করতে, দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করতে, সর্বোপরি জীবনকে চিনে নেওয়ার প্রস্তুতিকে পূর্ণতা দিতে সহায়ক হয়েছে—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক চেতনাবোধে উদ্বদ্ধ হয়েছিলেন। সৈনিক জীবনের শৃঙ্খলাবোধ ও সংঘবদ্ধ সমবায়ী জীবনবোধে আমাদেরও উৎসাহিত করতেন। তিনি সন্ধ্যা বা সকালে যখন হাঁটতেন আমাকে নিয়ে, বলতেন আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলো।
রণদা প্রসাদ সাহা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে নারীর স্বাস্থ্যসেবাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল, নারীশিক্ষার জন্য ভারতেশ্বরী হোমস। ১৯৪৩ সালে কুমুদিনী মহিলা মহাবিদ্যালয়। বলতে গেলে আমি এই পরিবারের উদার মানসিকতার ঐতিহ্য নিয়েই গড়ে উঠেছি।

প্রশ্ন:

সাফল্যের গোপন রহস্য কী?

শ্রীমতী সাহা: সাফল্য যা পেয়েছি, তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে আমার পরিবারে। সবার ভালোবাসাই আমার প্রাণশক্তি।

প্রশ্ন:

সমাজসেবার কোন বিষয়কে আপনি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখেন?

শ্রীমতী সাহা: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ! এই মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, পেয়েছি একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; কিন্তু ব্যক্তিজীবনে যা হারিয়েছি, তার কোনো হিসাব মেলাতে পারি না আজও।
১৯৬৭ সালের ১১ মে আমাদের বিয়ে হয়। ১৯৬৮ সালে ২৬ মার্চ আমার ছেলে রাজীব প্রসাদের জন্ম। ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর গ্রামে গণহত্যা ও লুটতরাজ চালায়। আমরা পুরো পরিবার তখন মির্জাপুরে কুমুদিনী কমপ্লেক্সে। আমার শ্বশুর দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও স্বামী ভবানী প্রসাদ সাহা নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী কমপ্লেক্সে কাজের জন্য সেখানে ছিলেন। সেদিনই রাত ১১টা ৩০ মিনিটে পিতা-পুত্রকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের আর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাইনি আমরা। সে রাতের অন্ধকার প্রসারিত হতে লাগল আমাদের জীবনে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কাটতে লাগল আমাদের জীবন। এই অসহায় অবস্থায় কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের হাল ধরলেন আমার ছোট ননদ মিসেস জয়াপতি। দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু চারদিকে স্বজন হারানোর হাহাকার। অর্থনৈতিক অবস্থাও নাজুক। এ অবস্থায় জয়াপতি স্বামী–সন্তান হারানো অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতেই গড়ে তুললেন কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট, যা পরবর্তী সময়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার অসহায় নারীর আত্মকর্মস্থানের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। নারায়ণগঞ্জে ও মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালকে কেন্দ্র করে ৭৩ সালে নার্সিং স্কুল। নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও মানবসেবার মানসে আমাদের সব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
আমি বিশ্বাস করি, নারীর ভেতরে এক ওই ঐশ্বরিক শক্তি আছে। সে সব পারে। সে সময়ে নিজের শোক বুকে চেপে স্বামী–পুত্র হারানো শোকে স্তম্ভিত শাশুড়ি, সন্তান, সংসারের সবার দেখাশোনা—সব সামলে বাইরে কাজ শুরু করেছিলাম। ঘরে-বাইরে কাজের মধ্যেই নিজের শান্তি খুঁজে নিয়েছি। আগে কাজ করেছি ছোটদি জয়াপতির সঙ্গে, এখন কাজ করছি কুমুদিনী পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে। কাজই আমাদের পথচলার মূলমন্ত্র।