মেডিকেল শিক্ষা—৩
ভর্তি থেকে আয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা
সরকারি কলেজের চেয়ে বেসরকারিতে ভর্তি ফি ১২০ গুণ বেশি। এ ব্যাপারে নজরদারির ঘাটতি আছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারে।
গড়ে একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৪০ হাজার মার্কিন ডলার নেওয়া হয়।
২০২১–২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি খাত থেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো আয় করবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আয়ের বড় একটি অংশ আসবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সরকারি কলেজের চেয়ে বেসরকারিতে ভর্তি ব্যয় ১২০ গুণ বেশি। বেসরকারি কলেজের উন্নয়নের কথা বলে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এ বিপুল পরিমাণ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
সরকারি মেডিকেল কলেজ ২০২১–২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ এমবিবিএস ভর্তি শেষ হয়েছে। এখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় দৈনিকগুলো বেশ কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তিসংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ছেপেছে।
কয়েকটি কলেজের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২১ জুন থেকে আবেদনপত্র বিক্রি শুরু। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৭ জুলাই। ১৪ জুলাই থেকে ভর্তি শুরু। ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ হবে ২৮ জুলাই। ১ আগস্ট থেকে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে। তবে একাধিক মেডিকেল কলেজ বিজ্ঞাপনে বলেনি যে কবে ভর্তি শুরু আর কবে শেষ।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৭৩টি। ২০২১–২২ শিক্ষাবর্ষে এসব কলেজে ৬ হাজার ৩৫৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ আছে।
১২০ গুণ বেশি
বিজ্ঞাপনে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে রাজধানীর ডেলটা মেডিকেল কলেজ থেকে বলা হয়, ভর্তি ফি ১৮ লাখ টাকা, প্রতি মাসের বেতন ৮ হাজার টাকা করে। গাজীপুরের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত সহকারী প্রথম আলোকে বলেন, আসনপ্রতি ভর্তি ফি ১৮ লাখ টাকা, প্রতি মাসের বেতন ৮ হাজার টাকা। ভর্তি ফি কে ঠিক করেছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে একাধিক কলেজ কর্তৃপক্ষ বলেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। একই কথা বলেছেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে বেসরকারি মেডিকলে কলেজের ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফি ঠিক করে দিয়েছিল। ওই বছর ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, একজন শিক্ষার্থীর মোট ফি ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা, ইন্টার্নি ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং টিউশন ফি ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। থাকা–খাওয়ার খরচ এ হিসাবের বাইরে।
তবে ভর্তি বাবদ কে কত টাকা নিচ্ছে, তার হিসাব কেউ রাখে না। এ ব্যাপারে কোনো নজরদারিও নেই। গতকাল চট্টগ্রামের একটি মেডিকেল কলেজের গভর্নিং বডির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, গত শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সময় তাঁরা একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ হাজার টাকা প্রথম দুই মাসের বেতন। ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ইন্টার্ন ফি। এর বাইরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতিবছর ৫০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে।
সে তুলনায় সরকারি মেডিকেল কলেজে ব্যয় অনেক কম। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ১০ হাজার টাকা। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি সাড়ে পনেরো হাজার টাকা। তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি কলেজের চেয়ে বেসরকারিতে ভর্তি ব্যয় ১২০ গুণ বেশি।
কত টাকা ওঠে
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারে। সেই হিসাবে ২ হাজার ৮৬০ জন বিদেশি শিক্ষার্থীর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আছে। তবে গত কয়েক শিক্ষাবর্ষের ভর্তির অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, অত বিদেশি শিক্ষার্থী আসেন না। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সূত্র বলছে, দেড় হাজারের কিছু বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আসবেন। দেড় হাজার আসন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চলে গেলে দেশি শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে ৪ হাজার ৮৫৩টি আসন। ১৮ লাখ টাকা করে নিলে তাঁদের কাছ থেকে ৮৭৩ কোটি টাকা পাবে কলেজগুলো।
বিদেশিদের ক্ষেত্রে কী হয়
দেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ফি নির্দিষ্ট করা থাকলেও বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা নেই। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি–ইচ্ছুক বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার কোনো ফি নির্ধারণ করে দেয়নি। কলেজগুলো নিজেরাই এটা ঠিক করে।
গতকাল চারটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। একটি মেডিকেল বলেছে, তারা পাঁচ বছরের জন্য ৪২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার নেয়। থাকা–খাওয়া এর বাইরে। অন্য একটি মেডিকেল কলেজ বলেছে, ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। ৪০ হাজার মার্কিন ডলারের কম কেউ বলেননি। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র বলছে, যেসব মেডিকেলের সুনাম আছে, তারা বেশি নেয়।
অর্থাৎ এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫৫২ কোটি টাকা (১ ডলার ৯২ টাকা হিসাবে) পাবে ভর্তির সময়। সব মিলে কলেজগুলো ওঠাবে ১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
গত শিক্ষাবর্ষে রাজধানীর কাছের একটি মেডিকেল কলেজ ১৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করেছিল। এর মধ্যে দেশি ৭৫ জন, বিদেশি ৭৫ জন। এ বছরও একই সংখ্যক শিক্ষার্থী তারা ভর্তি করাবে। ভর্তি থেকে তাদের আয় হবে ৪১ কোটি টাকার বেশি।
উন্নয়নের কথা বলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এখনো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উন্নয়নের জন্য এই ফি নিয়ে চলেছে। তবে এই টাকা উন্নয়নের কাজে ব্যয় হয় কি না, তা দেখার ব্যবস্থা সরকারের নেই। (শেষ)