শাড়ির হলুদ সিল্কের পাড়ে মোগল আমলের রাজা আর রানি মুখোমুখি বসে আছেন। শাড়ির কুঁচির নিচের দিকের নকশা এটি। আর ওপরের মসলিন পাড়ে ফুলের ছবি। রাজা-রানির ছবি ইন্টারনেট থেকে নিয়ে তা হাতে এঁকেছেন মো. সাদিত উজ জামান। শুধু তা-ই নয়, বিয়ের কার্ডও তিনি নিজেই হাতে এঁকে বানিয়েছেন। কার্ডে এঁকেছেন গোলাপ ফুল।
পরম যত্নে এই শাড়ি আর কার্ড বানিয়েছেন বোন স্নেহা জামানের বিয়ের জন্য। বোনের খুব শখ ছিল তাঁর বিয়েতে যাতে ভাই নিজের হাতে কিছু না কিছু বানিয়ে দেন। ভাইও বোনের শখ অপূর্ণ রাখেননি।
গত ২৩ মে রাজশাহীতে স্নেহা জামানের বিয়ে হয়। স্নেহা দাঁতের হবু চিকিৎসক। আর বর ফারহানুর রহমান খান প্রকৌশলী। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দুই পরিবারের খুব কাছের আত্মীয়স্বজনই শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত ছিলেন। মুঠোফোনে সাদিত জানান, বিয়ে নিয়ে বর–কনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদেরও অনেক পরিকল্পনা থাকে। তাই ঘরোয়া আয়োজনে যতটুকু সম্ভব, সবই চেষ্টা করা হয়েছে।
করোনায় সীমিত পরিসরে বিয়ে। তাই বলে বন্ধুরা কেন বোনের বিয়ের আনন্দ থেকে বাদ থাকবে? সাদিত বোনের বিয়ের আগে থেকে ফেসবুকে ছবি দিয়ে গল্পগুলো বলেছেন। বিয়ের ভিডিও শেয়ার করেছেন। এখনো দিচ্ছেন। এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সাদিতের বন্ধুমহল বিয়েতে উপস্থিত না হয়েও বিয়ের পুরো আনুষ্ঠানিকতা উপভোগ করতে পেরেছে।
সাদিত বলেন, ‘স্নেহা আগে থেকেই শখ করে ছিল ওর বিয়েতে আমি যেন নিজের হাতে কিছু বানিয়ে দিই। করোনায় হুট করেই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। হাতে সময় ছিল খুবই কম। তারপরও বোনের শখ পূরণের চেষ্টা করেছি। বোনও শাড়িটা হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। বাইরের কোনো অতিথি বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও নিজেদের জন্যই কার্ড বানিয়েছি।’
সাদিত আরও বলেন, বিয়েতে বাইরের বা দূরের আত্মীয়-বন্ধু উপস্থিত না থাকায় আনুষ্ঠানিকতা কম ছিল। করোনা না থাকলে হয়তো এটা সম্ভব হতো না। আর শুধু ঘনিষ্ঠ বা কাছের স্বজনেরা ছিলেন বলে প্রতিটি আয়োজনে আন্তরিকতাটা একটু বেশি মাত্রায় ছিল। পদ্মা নদীর পাড়ে মায়ের বন্ধুর একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হয়েছে। অন্যান্য আয়োজন হয়েছে বাসায়।
বর ও কনের দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। বরের বাবা চিকিৎসক রেজাউর রহমান খান এবং মা চিকিৎসক শায়লা হাবিব। আর কনের বাবা ব্যবসায়ী ফরহাদ উজ জামান এবং মা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাবিবা ই আমিন। দুই পরিবারের বাসাও খুব কাছাকাছি। বর ও কনের মা দুই বান্ধবী। দুই বাবার বন্ধুত্বও দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রে বর ও কনের মধ্যেও ছিল বন্ধুত্ব। একপর্যায়ে দুই পরিবারের সম্মতিতে তা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়।
সাদিত বিবিএ ও এমবিএ করেছেন ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে। তবে ছোটবেলা থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল আঁকাআঁকিতে। এখন পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। ‘টি-ব্যাগ স্টোরিজ’ নামে ফেসবুকে একটি পেজে তিনি টি-ব্যাগে আঁকা শিল্পকর্ম তুলে ধরেন। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকিয়ে হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছেন।
সাদিতের ফেসবুকে ঢুঁ দিয়ে দেখা গেল, শিল-পাটায় হলুদ বাটা থেকে শুরু করে বিয়ের ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই করা হয়েছে স্নেহার বিয়েতে। সাদিত বলেন, স্নেহার শাশুড়ি স্নেহাকে যে গয়না উপহার দিয়েছেন, তা ছিল তাঁর নিজের বিয়ের গয়না।
বংশপরম্পরায় চলা এ উপহার পেয়ে স্নেহা খুশি হয়েছেন। যদিও স্নেহার শাশুড়ি গয়নাগুলো দিয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী তা নতুন করে গড়ে নিতে বলেছিলেন।
সাদিত জানান, স্নেহা এ গয়নার ডিজাইনে কোনো পরিবর্তন আনেননি। এতে তাঁর শাশুড়ি নিশ্চয়ই মনে মনে অনেক খুশি হয়েছেন।
স্নেহা নিজেও আঁকাআঁকি বা নতুন নতুন জিনিস বানাতে পছন্দ করেন। নিজের বিয়ে বলে তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। তাই ছেলের বাড়িতে পাঠানোর জন্য উপহারের বক্সগুলো নিজেই কাপড় দিয়ে র্যাপিং করেছেন। হলুদের গয়না অনলাইন থেকে কিনলেও তাতে ফুল বসিয়ে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছেন।
সাদিত বলেন, বাড়িতে তাঁর শিল্পকর্মের বড় সমঝদার ছিলেন স্নেহা। টি-ব্যাগ স্টোরিজ বা প্রচ্ছদ, যা–ই আঁকতেন, তা আগে দেখাতেন স্নেহাকে। ফলে, ভাইবোনের বোঝাপড়াটা বেশি ছিল। সাদিতের আরেক বোন ফারিয়া জামান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন।
সাদিত বলেন, ‘বোনের বিয়েতে নিজে কিছু বানিয়ে দিতে পেরেছি, এটা আমার জন্যও ছিল অনেক আনন্দের। বিয়েতে আমার ৮০ বছরের বেশি বয়সী দাদি বিলকিস বেগম, আমার মা, স্নেহার শাশুড়ি এবং আমি গান গেয়েছি। বরের বাবা ও আমার ৮০ বছরের বেশি বয়সী বড় খালা সুলতানা রাজিয়া কৌতুক পরিবেশন করেছেন। এভাবে বিয়েতে উপস্থিত সব সদস্যই কিছু না কিছুতে অংশ নিয়ে সবাইকে আনন্দ দিয়েছেন। এখন চাই বোন তার নতুন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকুক।’