ভাষানটেকে নিম্নবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ

রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে অবস্থিত ভাষানটেকে ‘ঢাকা মহানগরীর বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্তদের ঢাকায় সরকারি জমিতে বহুতলবিশিষ্ট ভবনে পুনর্বাসন প্রকল্প’ (ভাষানটেক প্রকল্প) লক্ষ্য পূরণ না করেই মেয়াদ শেষ করেছে।
২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে পাঁচ বছরে মোট ১৩ হাজার ৬৬০টি ফ্ল্যাট তৈরির কথা ছিল। কিন্তু নয় বছরে হয়েছে দুই হাজার ১৬টি ফ্ল্যাট। প্রকল্পে সরকারের দেওয়া ৪৭ দশমিক ৯০ একর জমিতে ১১১টি ভবন তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১৮টি। অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে ১১টি ভবন।
এই প্রকল্পে বস্তিবাসীদের জন্য ২১৫ বর্গফুট এবং নিম্নবিত্তদের জন্য ৩৯৫ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট নির্মিত হয়েছে।
প্রকল্প চলার মাঝপথে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য নির্মাণপ্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এনএসপিডিএল) সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে কাজ চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে ফ্ল্যাটের জন্য অর্থ দেওয়া ৮২৩ জন গ্রাহককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে, সেই সঙ্গে বাকি ফ্ল্যাটগুলোর কাজ অসমাপ্ত রেখেই গত ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ করল ভূমি মন্ত্রণালয়।
ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য যাঁরা অর্থ দিয়েছিলেন এবং পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত তাঁদের হতাশ করেছে। ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমাদের করার কিছু নেই। সরকারের শেষ সময়। এ মুহূর্তে নতুন করে আমরা এর দায়িত্ব নিতে পারব না।’
নিম্নবিত্ত আর বস্তিবাসী মানুষের টাকা আর সরকারের জমি দিয়ে নির্মাণপ্রতিষ্ঠান এনএসপিডিএল ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করে। শুরু হয় কাজ। ১০ বছরের কিস্তি আদায়ের শর্তে বস্তিবাসীদের ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছিল দুই লাখ টাকা। আর চার কিস্তিতে আদায়ের শর্তে নিম্নবিত্তের জন্য ফ্ল্যাটের দাম তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু নির্মাণ শুরুর পর যে অর্থ নেওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে বেশি অর্থ নেওয়া ও প্রকৃত নিম্নবিত্তদের বরাদ্দ না দেওয়ার নানা অভিযোগ উঠতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ভাষানটেক প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) এক তদন্তে বলা হয়, প্রকল্পে ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ৬০ ভাগ বস্তিবাসী এবং ৪০ ভাগ নিম্নবিত্তদের দেওয়ার চুক্তি থাকলেও আবেদনপত্র ক্রয়কারীদের বেশির ভাগ অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। নির্মাণপ্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহিম খেয়ালখুশিমতো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। নিজের অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে সন্ত্রাসীদের দিয়ে তাঁদের মারধর, প্রয়োজনে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে কোণঠাসা করে রেখেছেন। অনিয়ম উদ্ঘাটন করে আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে থানায় মামলা এবং দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
অনিয়মের অভিযোগে সরকার এনএসপিডিএলের সঙ্গে ২০১০ সালের অক্টোবরে চুক্তি বাতিল করে। এর মধ্যে ৯৩৮টি পরিবার তাদের ফ্ল্যাটে উঠে পড়ে। নির্মাণপ্রতিষ্ঠানটি এসব বরাদ্দগ্রহীতার কাছ থেকে ৫৭ কোটি চার লাখ ১৭ হাজার টাকা এবং সাধারণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ৪২ কোটি টাকা নেয় বলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে জানা যায়। ২০১০-এর নভেম্বরে প্রকল্পের দায়িত্ব নেয় ভূমি মন্ত্রণালয়।
যাঁরা অর্থ দেওয়ার পরও ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পাননি, তাঁদের সমস্যা সমাধানে ভূমি মন্ত্রণালয় একটি দায়দেনা কমিটি করে। কমিটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি এমন এক হাজার ২০৭ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। ফ্ল্যাটে বসবাসকারী ৯৩৮ জনকে নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে দায়দেনা কমিটির সুপারিশ থাকলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এই প্রকল্পে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অরক্ষিত পড়ে রয়েছে বলে ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র দাবি করে।
ফ্ল্যাট যখন স্বপ্ন: ২০০৬ সালে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন সরকারি চাকুরে আবুল হোসেন। সেই টাকা ফেরত পাননি। ফ্ল্যাট এখনো দূর অস্ত। ভূমি মন্ত্রণালয় চলে যাচ্ছে এমন খবরে তিনি বললেন, ‘এখন কার কাছে গিয়ে আমরা দাবি করব? ভোগান্তির শেষ থাকবে না।’
এ ছাড়া, এই প্রকল্পে গত জানুয়ারিতে ৫৯১টি বস্তিবাসী পরিবার প্রত্যেকে এককালীন মাত্র ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট পায়। এর ফলে স্থানীয় আরও বস্তিবাসীর মধ্যে ফ্ল্যাট পাওয়ার ব্যাপারে আশার সঞ্চার হয়েছিল।
ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এভাবে প্রকল্প ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রণালয় মানুষকে বিপদে ফেলল। মন্ত্রণালয় শক্ত হলে মানুষের কষ্টের টাকা নিয়ে এনএসপিডিএল চলে যেতে পারত না।
প্রকল্প বানচালের অভিযোগ: মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ের ভেতরে একটি চক্র আছে, যারা চাইছে না প্রকল্পটি চলুক। সামনে সরকার বদল হয়ে গেলে আবার ওই নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিতে একটি চক্র তৎপর। এই চক্রটি ভূমিমন্ত্রীকে বুঝিয়ে প্রকল্পটি থেকে মন্ত্রণালয়কে দূরে সরিয়ে রাখছে।
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘এমন কোনো চক্র আদৌ আছে কি না, তা আমার জানা নেই।’
যেসব মানুষ নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছিলেন, তাঁদের কী হবে—প্রশ্নের উত্তরে ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘তারা তো আমাদের দেয়নি, আমরা এর দায় নেব কেন?’
তবে মন্ত্রীর কথার সঙ্গে একমত নন ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের দায় মিটিয়ে না আসাটা ঠিক হচ্ছে না। এখন এসব মানুষ কার কাছে যাবে?’ তিনি মনে করেন, ভূমি মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। ‘তবে কোনো একটি মহল হয়তো চায় না মন্ত্রণালয় কাজটি করুক’—মন্তব্য তাঁর।
ভাষানটেক প্রকল্পটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পুণ্যব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এর কাজ এগিয়ে নিতে সক্ষম। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের ওপর।’
ভাষানটেক প্রকল্পে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে ভূমিমন্ত্রী জানালেও তা কত দূর এগিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর মেলেনি।
মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, কাজটি মোটেও এগোয়নি। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের প্রাক-সভায় ভাষানটেক পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব উঠলেও প্রস্তাবটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় তা গ্রহণ করা হয়নি।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে নির্মাণপ্রতিষ্ঠান এনএসপিডিএলের কার্যালয়টি বন্ধ রয়েছে। এর প্রকল্প কর্মকর্তা আবদুল মান্নান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রধান আবদুর রহিম গত ৭ মে দেশ থেকে চলে গেছেন। সরকার পরিবর্তন হলে আবার দেশে ফেরত এসে কাজ পাবেন এমন আশা পোষণ করেন মান্নান।