‘ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক বিষয় আমাকে আকর্ষণ করেছিল’

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আহমদ রফিক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে লেখালেখিকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর গবেষণার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ভাষা আন্দোলন। এ নিয়ে তাঁর বই প্রায় ২০টি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাইল সাদী

আহমদ রফিক
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের একজন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিস্তর গবেষণাও করেছেন। বাঙালির অন্যতম বৃহত্তর এই আন্দোলন নিয়ে গবেষণাকাজ শুরু করেছিলেন কোন সময় থেকে?

আহমদ রফিক: গবেষণাটা শুরু করেছি একটু দেরিতেই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ভূমিকা নিয়ে একটি ছোট বই লিখেছিলাম। বইটির নাম একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস। এরপর আমার মনে হলো ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক তথ্য অনুদ্‌ঘাটিত রয়ে গেছে। প্রথমে গবেষণা শুরু করেছিলাম শহীদদের সংখ্যা নিয়ে; এরপর কারা কারা শহীদ হলেন, তাঁদের নিয়ে। একদিন তৎকালীন দৈনিক বাংলার স্নেহভাজন সাংবাদিক নূরে আলম আমাকে নিয়ে যায় আজিমপুর গোরস্থানের পশ্চিম দিককার নতুন পল্টন লাইন এলাকায়। সেখানে সুরুজ্জামান নামের একজন কবরখোদক এবং মৌলভি গফুর নামের একজনের সঙ্গে দেখা হয়, যিনি মরদেহ দাফন করতেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে একজন কিশোরসহ কমপক্ষে তিনজনের মরদেহ দাফন করা হয়েছিল। দুজন কর্মকর্তা হুকুম দিচ্ছিলেন, জলদি দাফন করো, জলদি দাফন করো। এটা জানার পর ভাবলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের বিভিন্ন দিক অজানা রয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। এর বাইরে একুশের আন্দোলন কীভাবে গ্রামপর্যায়ে বিস্তার লাভ করলাম, সেগুলোর খোঁজখবরও করা দরকার। এভাবেই আমার গবেষণা কার্যক্রম শুরু।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দাফনকাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আর কিছু কি জানা গিয়েছিল?

আহমদ রফিক: ২২ ফেব্রুয়ারির বিষয়েও তাঁরা বলেছিলেন। আমরা সচরাচর একজন কিশোর, একজন রিকশাওয়ালা আবদুস সালাম ও হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমানের নাম জানি। সিরাজুদ্দিন নামেও একজন শহীদ হয়েছিলেন, যাঁর কথা আমিই প্রথম জানতে পারি। বাসাবাড়ি লেন তাঁতীবাজারে তাঁর বাড়ি। তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। মৃত্যুর আগে বিড়বিড় করে বলে গিয়েছিলেন নাম-ঠিকানা, যেন তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। কলতাবাজারের নান্না মিয়া ওই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিই জানিয়েছেন। তবে আমার মনে হয়, ২২ তারিখে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যাঁদের কথা আমরা জানতেই পারিনি। এ বিষয়ে আরও গবেষণা করা দরকার ছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি এ বিষয়ে কতটা নতুন দিক উন্মোচন করতে পেরেছেন?

আহমদ রফিক: শহীদের সংখ্যার ব্যাপারে আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা সম্পন্ন করতে পারিনি। পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে কী আছে, সেটা জানতে পারলে ভালো হতো। আমি এ বিষয়ে বহুবার লিখেছি। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই পুলিশের সেই গোপন প্রতিবেদন প্রকাশে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে আমেরিকার নীতিটা ভালো। তারা নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের পুরোনো অনেক গোপন নথি উন্মুক্ত করে দেয়। এখানেও যেন তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেটার জন্য আমি অনেকবার লিখেছি। আমি মনে করি, পুলিশের সেই গোপন প্রতিবেদনে ২১ এবং ২২ ফেব্রুয়ারিতে কতজন শহীদ হয়েছিলেন, তার সঠিক তথ্যটা পাওয়া সম্ভব। দুর্ভাগ্য, এত দিনেও সেটা আমরা পাইনি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়াও কোনো দিন পাইনি। ভোরের কাগজ–এর তৎকালীন সম্পাদক এবং বর্তমান প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে ধারাবাহিকভাবে লেখার অনুরোধ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই লেখাগুলো গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া নামে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষায়তন পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করেছিল। নবম-দশম শ্রেণির ছাত্ররা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছিল। তারা বহিষ্কৃত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে অনেক কিশোর-তরুণের শিক্ষাজীবন থেমে গিয়েছিল চিরতরে, তাদের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। এককথায় উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই দিকগুলো নিয়ে কোনো কেউ কাজ করেননি। এগুলোর কিছুটা আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। কিন্তু এটা একার কাজ নয়। ওষুধশিল্প, নাগরিক পত্রিকা, রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্র নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাজগুলো আমার পক্ষে যতটা করা দরকার ছিল, ততটা করতে পারিনি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি পারেননি সময়ের অভাবে। কিন্তু আপনার জানামতে আর কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান কি এ বিষয়ে বড় পরিসরে গবেষণার জন্য এগিয়ে এসেছিল?

আহমদ রফিক: আমি অবাক হই, এ বিষয়ে আর কেউ গবেষণায় এগিয়ে আসেননি। একমাত্র সদ্য প্রয়াত এম আর মাহবুব কিছুটা কাজ করতে এগিয়ে এসেছিল। আমরা যৌথভাবে কয়েকটি বইও প্রকাশ করেছিলাম। সে আমার দক্ষিণহস্ত হিসেবে কাজ করেছে। আমরা একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলাম শহীদ মিনারের ওপর। আমি মনে করি, ভাষা আন্দোলনের একটা বড় অনুষঙ্গ হলো শহীদ মিনার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তো এখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলের দাবি-দাওয়া ও প্রতিবাদের যজ্ঞভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তেমনি সারা দেশেও শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে, বহুবার ভাঙা হয়েছে, আবার নির্মিত হয়েছে। সরকার বা পুলিশ বারবার সেগুলো ভেঙে দিয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তো ভেঙেছেই। এই শহীদ মিনারের ভাঙা–গড়ার ইতিহাস নিয়ে কাজ করব বলে একটা প্রজেক্ট চেয়েছিলাম এক প্রকাশকের কাছে। প্রকাশক ভদ্রলোক পিছিয়ে যাওয়ায় কাজটা নিয়ে আর বেশি দূর এগোতে পারিনি। অথচ এটা একটা জরুরি কাজ ছিল। একুশের আন্দোলনের পর সারা দেশে শহীদ মিনার কতগুলো হয়েছিল, কত তারিখে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, প্রতিবাদে আবারও নির্মিত হয়েছিল। এগুলো ইতিহাস। কিন্তু এই বিষয়টা তালিকাবদ্ধ করতে পারলে তখনকার ভাষা আন্দোলনের একটি চিত্র জাতির সামনে স্পষ্ট করা যেত। আমি নিজের মতো করে যতটুকু লেখার সেটুকু চেষ্টা করেছি।

আরেকটা বিষয় হলো ভাষাশহীদদের তালিকা। একটা বিষয় আমার কাছে বড় করে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা তৈরি হলো, কিন্তু ভাষাশহীদদের তালিকা তৈরি করা হয়নি। এ ছাড়া একুশে এবং একুশের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ শহীদ মিনার থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের মতো করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে বহু খণ্ডে সংকলন করা এবং তা সংরক্ষণ করা দরকার ছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনারা ভাষাসংগ্রামীরা এ বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের কতটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন?

আহমদ রফিক: আমি একবার নয়, বহুবার এসব বিষয়ে লেখালেখি করেছি কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অথচ কেউ কর্ণপাত করেনি। আমি ব্যক্তি উদ্যোগে একটা বইও করেছিলাম একুশে চেতনার পরিষদের পক্ষে। বইটি গণ প্রকাশনী প্রকাশ করেছিল। এখানে দুই শ বাইশ-তেইশজন ভাষাসংগ্রামীর একটা তালিকা করেছিলাম। এরপর ঢাকার বাইরে থেকে আমার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছিল। এ সময় শহীদদের বেশ কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেছিলাম। এরপর শারীরিক অসুস্থতা এবং সাহিত্যের অন্য গবেষণা করতে গিয়ে কাজটি নিয়ে আর এগোতে পারিনি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনার গ্রন্থ ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাসের কতটা তুলে আনতে পেরেছে? আরও কতটা অনুদ্‌ঘাটিত রয়ে গেছে?

আহমদ রফিক: অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। যেমন চাটমোহরের আবুল হোসেন গ্রাম্য চিকিৎসক হিসেবে জীবযাপন করেছেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন মেহেরপুরের নজীর আলী, ইসমাইল হোসেন প্রমুখ। তাঁরা দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। এ কারণে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। আর পড়াশোনা করতে পারেননি। গ্রামে কৃষিসম্পদ থাকার কারণে এঁদের হয়তো জীবনযাপনের সমস্যা হয়নি কিন্তু উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অনেকের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। এ নিয়ে তাঁরা তাঁদের কষ্টের কথা বলেছেন। এ ধরনের অনেক সচেতন ছাত্রই কিন্তু তৎকালীন সরকারের দমনপীড়নের শিকার। এসব নানা বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গবেষণা করতে পারলে সারা দেশ থেকে ভাষা আন্দোলনের অনেক অজানা ঘটনা বা তথ্য পাওয়া যেত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলন নিয়ে আপনার আগেও গবেষণা হয়েছে, পরেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কার কার গবেষণা সত্যিকার অর্থে নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে?

আহমদ রফিক: এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা বদরুদ্দীন উমরের। তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিন খণ্ডের গ্রন্থ লিখেছেন। তবে আমি যে কথাগুলো বললাম, সেগুলো এই তিন খণ্ডের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের বাইরের ইতিহাস। তাঁর গ্রন্থে ঘটনাক্রম আছে। তাতে ভাষা আন্দোলনের যে ডালপালা এবং নানা রকম অনুষঙ্গ, এগুলো উঠে আসেনি। বশীর আল্‌হেলালের বইয়েও বিস্তারিত ঘটনাক্রম আছে। তবে দেলোয়ার সাহেবের রচনায় আঞ্চলিক ইতিহাসের বেশ কিছু দিক পাওয়া যায়। সেটাও সম্পূর্ণ নয়। সেই সম্পূর্ণ কাজটি সরকারি উদ্যোগে কিংবা কোনো বড় গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে করতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু তা হওয়ার দরকার ছিল ৩০-৪০ বছর আগে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা ছিল আপনার। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেও রয়েছে আপনার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এরপরও সক্রিয়ভাবে নানা কাজ করেছেন। আবার এ বিষয়ে গবেষণায় আসার কারণ কী?

আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলন গবেষণায় এসেছি এর চরিত্র এবং এর তাত্ত্বিক দিক তুলে ধরতে। ঘটনাপ্রবাহই ভাষা আন্দোলনের সব নয়। আন্দোলনের সফলতা, সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা এ তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আমাকে আকর্ষণ করেছিল। কেউ কেউ অবশ্য এ বিষয়ে লিখেছিলেন। এগুলো নিয়ে আমি অনেক প্রবন্ধ লিখেছি। সেগুলোর অধিকাংশই সংকলিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সামগ্রিক ভাষা আন্দোলনের চরিত্র কেমন, এর স্লোগানগুলোতে জনদাবির কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল, স্লোগানের বক্তব্যগুলো কেমন ছিল। ভাষা আন্দোলনের স্লোগানগুলো এর ইতিহাস রচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশেই বিভিন্ন ধরনের স্লোগান প্রচারিত হয়েছিল। ভাষাসংগ্রামীদের অনেকেই বলেছেন, স্লোগান ও পোস্টারগুলো সংরক্ষণ করা খুব দরকার ছিল। ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি হলেও সারা দেশেই তখন প্রচুর পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল। এগুলোর একটা প্রভাব তৈরি হয়েছিল তৎকালীন রাজনীতি ও সংস্কৃতির ওপর। এ বিষয়গুলো কিন্তু অন্য গবেষকদের লেখায় আসেনি।

সেই সময় বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব নিয়েও গ্রন্থ রচিত হতে পারত। বায়ান্ন সালের আগস্ট মাসেই কুমিল্লায় সম্মেলন হয়েছিল। কার্জন হলে হলো চুয়ান্ন সালে। এরপর হলো বিখ্যাত কাগমারী আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল একুশের প্রভাবে। একুশকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে কতটা পরিবর্তন ঘটাল, এ দিকগুলো নিয়ে এখনো গবেষণা ও লেখালেখির সুযোগ রয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলনের পর ধারাবাহিক নানা আন্দোলনের ফসল হিসেবে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা কেমন দেখেন, ভবিষ্যৎই-বা কেমন মনে করেন?

আহমদ রফিক: বাংলাদেশে বাংলা ভাষা এখন ব্যাকফুটে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে বাংলায় রেখে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা, উচ্চ আদালতে ইংরেজি রাখা একটা স্ববিরোধিতা। নামে রাষ্ট্রভাষা বাংলা কিন্তু জাতীয় ভাষার মর্যাদা তো আমরা দিতে পারিনি। আমাদের প্রথম স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, দ্বিতীয় স্লোগান ছিল ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, তৃতীয় স্লোগান ছিল ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন স্লোগান ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার কথা এখন অনেকেই বলছেন। আপনি এর কোনো সম্ভাবনা দেখেন কি না?

আহমদ রফিক: বহু জায়গায় এ বিষয়ে বক্তৃতা করতে গিয়ে বোকা হয়েছি। একবার বক্তৃতা দেওয়ার পর এক মহিলা আমাকে বললেন, ‘ছেলেমেয়ের ক্যারিয়ার তৈরি করতে আমার ইংরেজি মাধ্যম দরকার। বাংলা মাধ্যমে সেই সুযোগ পাবে না।’ তাহলে দেশ কতটা এগোবে? আপনি এর জবাব দিতে পারেন? আসল কথাটা হলো মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। ইউরোপের দিকে যদি তাকাই, দেখা যায় মাতৃভাষাই রাষ্ট্রভাষা, এরপর তাকে জাতীয় ভাষা করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরের মাতৃভাষার প্রয়োগ। এ চরিত্রই জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন—সর্বত্রই কিন্তু তা-ই। অথচ আমরা নামেই কেবল জাতিরাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা কিন্তু তা জাতীয় ভাষা বাংলা নয়। সেটা হলে আমাদের উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা, উচ্চ আদালতে বাংলা নেই কেন? চীন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশ প্রাচীন আদি চিত্রলিপির বর্ণমালার ভাষা নিয়ে যদি মহাকাশ বা আণবিক গবেষণা করতে পারে, তাহলে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নত বাংলা ভাষা নিয়ে কেন বিজ্ঞান গবেষণা করতে পারব না? সর্বত্র বাংলা চালু না হওয়ার পেছনে আসলে সদিচ্ছার অভাবটাই দায়ী। আর দায়ী পৌনে দুই শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: উচ্চশিক্ষার মাধ্যম যদি বাংলা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী হবে?

আহমদ রফিক: এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে বাংলা চালু খুব কষ্টকর। তবে অসম্ভব নয়। ব্যাপকভাবে যদি সরকারি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা যদি থাকে, দীর্ঘস্থায়ী বিশেষ সরকারি প্রকল্প যদি নেওয়া হয়, তাহলে এটা সম্ভব। এখানে অনুবাদের একটা ব্যাপার আছে। অনুবাদের জন্য বিরাট সেল গঠন করতে হবে। অবশ্যই করা যাবে, তবে এটা নিঃসন্দেহে শ্রমসাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষ এবং অর্থসাপেক্ষ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আহমদ রফিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ফেব্রুয়ারি ২০২২