১৯১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রতিবছর নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও (এসডিজি) নারীর সমঅধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি সমাজেই নারী-পুরুষের সমতাবিধানের কথা বলা হয়। এই সমতাবিধানের যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমতাবিধান আনতে নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ জোরালোভাবে আকর্ষণ করার দাবি রাখে। কারণ, ভাষা মানুষের মনস্তত্ত্ব গঠনের পাশাপাশি নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
উন্নত দেশগুলোয় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ভাষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য জ্ঞানশাখা ও গবেষণার উদ্ভব ঘটেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে সচেতনতা। একইভাবে প্রশাসনিক কাজকর্মের ভাষার ক্ষেত্রেও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের প্রয়াস বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ভাষা ব্যবহারে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ ও লিঙ্গসমতা আনার লক্ষ্যে বিশ শতকের সত্তরের দশকে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড জেন্ডার’ নামক ভাষাবিজ্ঞানের একটি উপশাখার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।
বাংলাদেশে একুশ শতকের শুরু থেকে ভাষা ব্যবহারে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার নানা প্রচেষ্টা দেখা যায়। আর এই কারণেই এখন বাংলা ভাষায় ‘রাষ্ট্রনায়ক’ সম্বোধনবাচক শব্দটি নারীদের নামের আগেও ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার ‘ছাত্রছাত্রী’ শব্দের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘শিক্ষার্থী’।
ইংরেজিতে এখন আর ‘চেয়ারম্যান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় না। এর বদলে ‘চেয়ারপারসন’ বা ‘চেয়ার’ শব্দের ব্যবহার বর্তমানে লক্ষণীয়।
একইভাবে ইংরেজি ভাষায় লিঙ্গসমতা আনতে ‘ফায়ারম্যান’ ও ‘পোস্টম্যান’ শব্দের বদলে যথাক্রমে ‘ফায়ার ফাইটার’ ও ‘লেটার ক্যারিয়ার’ শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘ম্যান’ বা ‘মেন’ শব্দের বদলে ‘হিউম্যান’ বা ‘হিউম্যান বিয়িংস’ শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় এখনো ব্যাকরণ শিক্ষায় পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ শেখানো হয়। বাংলা ব্যাকরণের অংশ হিসেবে পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ জ্ঞানার্জনের জন্য জানার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কাছে ভাষা ব্যবহারে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার শিক্ষা থাকা আবশ্যক। আর এই শিক্ষা বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হলে তার প্রচার ও প্রয়োগ নিঃসন্দেহে বাড়বে।
বাংলাদেশে নারীর জন্য ব্যবহৃত ভাষার ক্ষেত্রে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তবে এ দেশে নারীর ক্ষমতায়নের পটভূমিতে বাংলা ভাষায় প্রয়োগকৃত দুটি শব্দের ব্যবহার সবার চিন্তার জগতে নাড়া দিতে পারে। শব্দ দুটি হলো—‘স্যার’ ও ‘সভাপতি’।
‘স্যার’ শব্দটি ইংরেজি। কিন্তু তা বাংলা ভাষায় বর্তমানে কৃতঋণ শব্দ হিসেবে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। শব্দটি পুরুষবাচক। একইভাবে ‘সভাপতি’ শব্দটিও পুরুষবাচক। কোনোভাবেই এই শব্দগুলো জেন্ডার–নিরপেক্ষ নয়। অথচ দেশে এই দুটি শব্দ নারীদের সম্বোধনের ক্ষেত্রেও দাপটের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে।
‘স্যার’ শব্দটি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রায়ই নারীদের সম্বোধনে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, নারী সভাপ্রধানের ক্ষেত্রে ‘সভাপতি’ শব্দটি মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে। অথচ নারীদের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ শব্দের বদলে ‘ম্যাডাম’, ‘সভাপতি’ শব্দের বদলে ‘সভাপ্রধান’ খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। এতে ভাষা ব্যবহারে লিঙ্গসমতা আসে।
মানুষের ভাষা, মনস্তত্ত্ব ও চিন্তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মানুষ কী চিন্তা করে কিংবা তার মানসিক গঠন ও মানসিকতা কী রকম, তা অনেকাংশই ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, মানসিকতা ও চিন্তা দ্বারা মানুষ তার ভাষাকে রূপ দেয়। তাই বলা যায়, মানুষের ভাষা ব্যবহারে লিঙ্গসমতা নিশ্চিত হলে তা তার চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে পারে। এটি লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
আজ ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখা দরকার।
ফিরোজা ইয়াসমীন: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়