ভিওআইপি: টেলিযোগাযোগ আইন সমস্যা?
অনুমোদনহীন ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার না হওয়ার পেছনে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করছেন তাঁরা।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব আবু সায়ীদ খান মনে করেন যারা অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এ আইন করা হয়েছে তাদের কল্যাণেই। টেলিযোগাযোগ আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলমের মতে, সরকারের সদিচ্ছাই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা নির্মূলে একমাত্র পথ।
এ খাতের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ আইনে ভিওআইপি অপরাধের স্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। কোন কোন কার্যক্রমের কারণে ভিওআইপি পরিচালনাকে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য করা হবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা নেই। আইনে ভিওআইপি লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হলেও লাইসেন্স না নিলে শাস্তির কোনো বিধান নেই।
টেলিযোগাযোগ আইনের ৩৫-এর ২ উপধারায় রয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘন করলে উক্ত লঙ্ঘন হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
কিন্তু কী কী কার্যক্রম পরিচালনা করলে কিংবা লাইসেন্স ছাড়া ভিওআইপি কার্যক্রম পরিচালনা করলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে কি না, সে অপরাধের শাস্তি কী হবে তাও উল্লেখ নেই। এ কারণে লাইসেন্সবিহীন ভিওআইপি কার্যক্রম পরিচালনাকারীকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করে চার্জশিট দিতে পারছে না পুলিশ। ফৌজদারি কার্যবিধি কিংবা অন্য কোনো ধারায় চার্জশিট দিলে অভিযুক্ত ব্যক্তি উচ্চ আদালতে এটিকে চ্যালেঞ্জ করছেন। থেমে যাচ্ছে মামলার বিচার। আসামিও খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। আইনটিতে অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধান না থাকায় পুলিশের সামনে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
আইনের ৭৮ ধারার উপধারা ২-এ রয়েছে, ‘এই আইন বা ইহার অধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানে বর্ণিত কোনো অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণত কমিশনের পরিদর্শক অনুসন্ধান, মামলা দায়ের ও তদন্ত সম্পাদন করিবেন।’
এ ধারা অনুসরণ করে অন্য কোনো সংস্থা বা পুলিশকে মামলার অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সময় লাগে সে সময়ে অপরাধীরা আলামত অন্যত্র সরিয়ে নেন। ফলে তদন্তকালে ঘটনাস্থলে অবৈধ ভিওআইপির সরঞ্জাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কিংবা অন্য বৈধ কোনো সরঞ্জাম এনে তারা রেখে দেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে সরাসরি এ মামলার অনুসন্ধান, মামলা দায়ের ও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলে অভিযুক্তরা দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিতে পারতেন না।
তবে ব্যারিস্টার তানজীব এ বিষয়ে বলেন, ২০০১ সালে আইনটি করার সময় অপরাধের ধরনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছিল। ভিওআইপি-সংক্রান্ত অপরাধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারিগরি ও আর্থিক দুর্নীতি-সম্পর্কিত হওয়ার কারণে বিটিআরসি কর্মকর্তাদের এর তদন্তে সম্পৃক্ত রাখার কথা বলা হয়েছিল। আইনটি করার সময় এর সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, কমিশনের কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে এসব মামলার তদন্ত ও তদারকি করতে পারলে সমস্যা হতো না।
আরেকজন আইনজীবী বলেন, আইনে বিটিআরসির পক্ষ থেকে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ আদালত এটিকে আমলে নেবেন পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে। ফৌজদারি আইনের মতো ভিওআইপি মামলা তদন্তে পুলিশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়।
২০০৭ সালে একটি ভিওআইপি মামলার বিচার করতে গিয়ে সিলেটের এক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিটিআরসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আইনটি সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর এক সার্কুলারে পুলিশকে ভিওআইপি মামলার অনুসন্ধান, মামলা দায়ের ও তদন্তের ক্ষমতা দেয় বিটিআরসি । তবে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে বিটিআরসির অনুমোদন নিতে হবে। এর আগে এসব মামলার ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে বিটিআরসির অনুমোদন নিয়েই মামলার তদন্ত করতে হতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব আবু সায়ীদ খান বলেন, অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যারা এ খাতের ক্ষতি করছে তাদেরকে প্রতিহত করার কোনো কিছু টেলিযোগাযোগ আইনে নেই।
কিন্তু ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম মনে করেন, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্বয়ের অভাবেই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীরা শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। তিনি ২০১০ সালে আইনটির সংশোধন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সব কিছুই ‘লেজে গোবরে’ হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। ২০১০ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনের কাছ থেকে অনেক ক্ষমতাই মন্ত্রণালয়ের হাতে নিয়ে নেওয়া হয়। এ সংশোধনীর ক্ষেত্রে ‘উদ্দেশ্য মহৎ ছিল না’ বলেও উল্লেখ করেন তানজীব-উল-আলম।