‘ভূতকে ভয় লাগে না, মানুষকে ভয় লাগে’

২০১৮ সালে টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন কাউন্সিলর একরাম। এখনো বিচারের আশায় তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে।

টেকনাফের বাসায় গতকাল একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগম, দুই মেয়ে নাহিয়ান হক ও তাহিয়াত হকছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার পানির ফোয়ারার পুব দিকে লামার বাজার সড়ক দিয়ে ১০০ গজ এগোলেই বাঁ পাশে প্রায় জরাজীর্ণ একটি দোতলা বাড়ি। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভাঙাচোরা দরজা, জানালার কাচ ভাঙা। দেয়ালের রং বিবর্ণ। বাড়িটির দোতলার বসার ঘরের চার দেয়ালে মার্কার কলমে লেখা, ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে।’ ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে?’ ‘ভূতকে ভয় লাগে না, মানুষকে ভয় লাগে।’ ‘আব্বু তুমি কোথায়?’ ‘তুমি কি আর জীবিত ফিরে আসবা না।’ ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনো বিচার পাব না?’ ‘আব্বু তুমি কেন নাই।’ ‘আব্বু তুমি কখন আসবা। প্লিজ চলে আস।’

কথাগুলো লিখেছে গতবার এসএসসি পাস করা তাহিয়াত হক ও তার ছোট বোন দশম শ্রেণির ছাত্রী নাহিয়ান হক। গত সাড়ে তিন বছরেও এসব লেখার কোনো জবাব পায়নি দুই বোন।

২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ হন তাহিয়াত ও নাহিয়ানের বাবা একরামুল হক। ঘটনার সময় তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ১২ বছর ছিলেন টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। ‘হত্যাকাণ্ড’টি ঘটার সময় মেয়েদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন শোনা যায় ফোনে থেকে যাওয়া রেকর্ডে। একরামের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনে মেয়ে ফোন করলে চাপ পড়ে রিসিভ হয়ে যায়। একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগমের মুঠোফোনে রেকর্ড হয়ে যায় গুলির শব্দ, শোরগোল। এই অডিও ভাইরাল হলে ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে।

আরও পড়ুন

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় হয় গত সোমবার। তাতে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ছয় আসামির যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হয়। এখন একরামের স্ত্রী আয়েশা মনে করছেন, স্বামী একরাম ‘হত্যা’র বিচার তিনি পাবেন।

গতকাল বুধবার দুপুরে টেকনাফে একরামের বাড়িতে কথা হয় তাঁর স্ত্রী আয়েশা বেগমের সঙ্গে। একরামের মৃত্যুর পর বিরাট দুর্দশায় পড়েছেন তিনি। জানালেন, একরামের এমন কোনো সম্পদ নেই, যা দিয়ে দুই মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চলবে। তাঁর স্বামী যেদিন নিহত হন, সেদিনও মোটরসাইকেলের তেল কিনেছিলেন ৫০০ টাকা ধার নিয়ে। শ্বশুরের দেওয়া জরাজীর্ণ বাড়িতে তাঁরা থাকেন। একরামকে কেন মারা হলো, সে প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাচ্ছেন না আয়েশা। তবে বিচার পাওয়ার আশা ও দাবি ছাড়েননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছরের মাথায় সিনহা হত্যার বিচার হলো। অথচ সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর স্বামীকে হত্যার ঘটনায় মামলা ও তদন্ত কিছুই হয়নি।

একরামুল হক

কথার ফাঁকে বারবারই চোখ চলে যায় দেয়ালচিত্র ও দেয়াললিখনের দিকে, যা এঁকেছে একরামের দুই মেয়ে তাহিয়াত ও নাহিয়ান। মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা দুজন এই প্রতিবেদকের সামনে এসে বসে। তবে কোনো কথা বলেনি, নির্বাক বসে ছিল। একবার শুধু বলেছে, ‘বাবা হত্যার বিচার চাই।’

বাসার জরাজীর্ণ পরিবেশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আয়েশা বলেন, দুই সন্তান নিয়ে খেয়ে–পরে বাঁচাই এখন কষ্টকর। আত্মীয়দের সহযোগিতায় কোনোরকমে বেঁচে আছেন।

আরও পড়ুন

একরাম যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন, তার পাঁচ দিন পর আয়েশা কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করে একরামের সঙ্গে তাঁর ও মেয়েদের শেষ কথোপকথনের অডিও রেকর্ড প্রকাশ করেন। এর একটি অংশ ছিল এ রকম:

মেয়ে: হ্যালো আব্বু!

একরাম: জি আম্মু। আম্মু আমি হ্নীলা যাচ্ছি।

মেয়ে: কেন?

একরাম: জরুরি কাজে যাচ্ছি।......মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, কেন?

একরাম: যাচ্ছি আম্মু.....(কান্নার স্বরে কথা)।

মেয়ে: যাচ্ছ; তুমি কান্না করতেছ যে...?

এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ ও গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়।

এই অডিও অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাবা–মেয়ের শেষ কথোপকথন শুনে এবং একরাম নিহত হওয়ার খবরটি জেনে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে।

আয়েশা জানান, তখন সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও সে ব্যবস্থা হয়নি। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমার স্বামী মাদক ব্যবসায়ী নন। তালিকায়ও নাম নেই। টাকাপয়সাও নেই। তাহলে ইয়াবা ব্যবসায়ী হলেন কী করে?’

আয়েশা অভিযোগ করেন, ঘটনার পর র‍্যাব বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল, সেখানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির বাবার নাম–ঠিকানার সঙ্গে তাঁর স্বামীর বাবার নাম–ঠিকানার মিল নেই।

বাবার প্রতি ভালোবাসা দুই মেয়ের।

ঘটনার পর গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে র‍্যাব লিখেছিল, ২৬ মে দিবাগত রাত ১টা ৫ মিনিটে র‍্যাব-৭–এর একটি চৌকস আভিযানিক দল কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার মেরিন ড্রাইভ এলাকায় অভিযান পরিচালনার সময় গুলিবিনিময়ের সময় যিনি নিহত হন, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যসায়ী ও ইয়াবা গডফাদার টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. একরামুল হক কমিশনার (৪৬), পিতা মোজাহার মিয়া ওরফে আবদুস সাত্তার, নাজিরপাড়া, টেকনাফ পৌরসভা, টেকনাফ, কক্সবাজার।

আয়েশা বলেন, একরামুলের বাবার নাম মোজাহার মিয়া নয়, তাঁর ঠিকানাও নাজিরপাড়া নয়। নাজিরপাড়া পৌরসভার বাইরে, সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৭৩ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১৮ নম্বরে নাম আছে এনামুল হকের, তাঁর বাড়ি নাজিরপাড়া, বাবার নাম মোজাহার মিয়া। এই এনামুল হকই প্রথম ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিজেকে নিরপরাধ ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে ফিরতে চাই নিরাপদ জীবনে’। পরে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এনামুল হক এখন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য।

বন্দুকযুদ্ধের পর টেকনাফ থানায় যে মামলা হয়, তাতে বলা হয়, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে একরাম মারা যান। ২০১৯ সালের ২৫ মে টেকনাফ থানা পুলিশ প্রথম আলোকে জানিয়েছিল, তদন্তে ঘটনার প্রমাণ না মেলায় মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

সাবেক যুবলীগ নেতা একরাম হত্যার বিচার চান কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সভাপতি সোহেল আহমেদ। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একরাম আওয়ামী পরিবারের সন্তান। দলের ত্যাগী নেতা। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাঁর খুন হওয়া দুঃখজনক। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।

প্রতিবেদন দেননি জেলা প্রশাসক

একরামের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্ত্রীর মামলা করতে না পারার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গত ২৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেয়। সেখানে বলা হয়, যেকোনো নাগরিকের বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। একরামের স্ত্রীর অভিযোগের বিষয় তদন্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ২৩ জানুয়ারির মধ্যে দিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয় কমিশন।

তবে প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি বলে গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদন না দিলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

এ উপেক্ষার কারণে মানবাধিকার কমিশন কী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে, প্রশ্নের জবাবে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কমিশন আইনের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমরা হাইকোর্টে রিট করতে পারি। তখন বিষয়টি হাইকোর্টের এখতিয়ারে চলে যাবে।’