ভূরাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ জরুরি

ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তাঁরা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। ঢাকা, ১৫ অক্টোবরছবি: রাহীদ এজাজ

যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে বেইজিং–ওয়াশিংটন সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়েই চলেছে। এতে কোভিড–১৯ এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। করোনা মোকাবিলায় টিকাসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতা দিয়ে চীন নিজেদের প্রভাববলয় বিস্তৃত করে চলেছে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের সফরকে এরই প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। আগামী সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সফরের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঢাকা-দিল্লি ঘুরে গেলেন স্টিফেন বিগান।

ঢাকা সফরে স্টিফেন বিগান গণমাধ্যমকে বলেছেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। তাই এ অঞ্চলে সম্পর্ক জোরদারের যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকছে বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (ভারত মহাসাগরীয় কৌশল বা আইপিএস) নিয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কারণ, আইপিএসে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী।

আমরা নতুন স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। নতুন স্নায়ুযুদ্ধ কখনো ছোট রাষ্ট্রের জন্য সুখকর হয় না। কাজেই বিশেষ কোনো কৌশল বা উদ্যোগে আমাদের জড়িত হওয়াটা ঠিক হবে না
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান, প্রেসিডেন্ট, বিআইপিএসএস

যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করুক আর না–ই করুক, বাংলাদেশসহ ৭০টির মতো দেশের মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় চীনের বিআরআইয়ের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আইপিএস নিয়ে এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করে। পরের বছরের শুরু থেকেই আইপিএস নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ওয়াশিংটন। তারা শুরু থেকেই এতে যোগ দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে যাচ্ছে। এর দুই বছর আগে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বিআরআইতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়। এরও দুই বছর আগে ২০১৪ সালে জাপানের বিগ বি বা দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টে (বঙ্গোপসাগরের শিল্প প্রবৃদ্ধি অঞ্চল) বাংলাদেশ সমর্থন জানায়। মোটামুটি ওই সময় থেকেই জাপান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিনিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের যুক্ততার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।

গত পাঁচ থেকে সাত বছরে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এসব উদ্যোগ আর বিনিয়োগ–সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ মুহূর্তে বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন—কোনোটাই ভূরাজনীতি আর কৌশলগত সম্পর্কের বাইরে নেই। আর্থিকভাবে সমর্থ দেশগুলো উদীয়মান দেশগুলোকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকে।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, এই অঞ্চল ঘিরে যে ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ আর কোনোভাবেই তার বাইরে নয়। তাই জাতীয় স্বার্থে দেশের উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এসব উদ্যোগের ব্যাপারে অবস্থান ঠিক করতে হবে। এ জন্য জাতীয় পরিমণ্ডলে একটি সমন্বিত নীতিগত কৌশল প্রণয়ন বাংলাদেশের জন্য জরুরি। ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের বাস্তবতায় বসবাস করেও বাংলাদেশের পক্ষে ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখা সম্ভব। তবে ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে দর–কষাকষির সুযোগ যাতে নষ্ট না হয়, সেটাকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করে। পরের বছরের শুরু থেকেই আইপিএস নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ওয়াশিংটন। তারা শুরু থেকেই এতে যোগ দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে যাচ্ছে

তিনটি কৌশলগত উদ্যোগ চীনের বিআরআই, জাপানের বিগ বি ও যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়নের যেকোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হবে ব্যবসা, বিনিয়োগ ও অর্থনীতি। তবে কোনো উদ্যোগে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার উপাদান থাকলে তা থেকে দূরে থাকবে বাংলাদেশ। এটাই বাংলাদেশের মূলনীতি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিআরআই, বিগ বি এবং আইপিএসের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান ঠিক করতে ২০১৮ সালের শেষার্ধে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কথা ছিল, মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এ বিষয়ে একটি সুপারিশ জমা দেবে। কয়েক দফা আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো অবস্থান ঠিক করতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়ে খুব দীর্ঘ সময় না নিয়ে, নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে একটি বাস্তবসম্মত এবং ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে হবে বাংলাদেশকে। আগামী কয়েক বছর ধরে বিশ্ব নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে কাউকে যেমন অসন্তুষ্ট করা যাবে না, তেমনি আবার স্বার্থও জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না। ভৌগোলিক অবস্থানের সুফল আদায়টা নিশ্চিত করতে হবে। চীনের সঙ্গে দর–কষাকষির জায়গা কোথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কী নিয়ে হবে, জাপানের সঙ্গে কোথায় দর–কষাকষি হবে, সেই প্রস্তুতিটাও বাংলাদেশের নিয়ে রাখতে হবে।’

ভারসাম্য ও অগ্রাধিকারে জোর

একাধিক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, ২০১৮ সাল থেকে জাপান বলছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিগ বিতে যুক্ত হয়েছে। অথচ বিগ বি–ভিত্তিক মহাপরিকল্পনার দলিলে মাতারবাড়ীর কোনো উল্লেখ ছিল না। ফলে জাপানের এমন দাবি বাংলাদেশকে অবাক করেছে। আবার ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, জাপানের মাতারবাড়ী প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রয়েছে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির পর বাংলাদেশের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে আসেন যে এরপর থেকে যেকোনো উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকতে হবে।

এদিকে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের বাস্তবতায় বসবাস করেও বাংলাদেশের পক্ষে ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখা সম্ভব। তবে ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে দর–কষাকষির সুযোগ যাতে নষ্ট না হয়, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভূকৌশলগত সুবিধা কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের স্বার্থে ভূ–অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এমন কোনো মনোভাব না দেখানোই বাংলাদেশের জন্য ভালো।

কৌশলগত নীতি প্রণয়ন জরুরি

বৈশ্বিক নানা পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে নতুন মেরুকরণ হতে যাচ্ছে। তাই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। যদিও অতীতে ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া আর সর্বশেষ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গড়া উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস নিয়ে যে সম্ভাবনার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বাস্তবে তা ঘটেনি। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত উদ্যোগে যুক্ততার জন্য নীতি প্রণয়ন অপরিহার্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বিআরআইতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়। এরও দুই বছর আগে ২০১৪ সালে জাপানের বিগ বি বা দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টে (বঙ্গোপসাগরের শিল্প প্রবৃদ্ধি অঞ্চল) বাংলাদেশ সমর্থন জানায়

শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নতুন স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। নতুন স্নায়ুযুদ্ধ কখনো ছোট রাষ্ট্রের জন্য সুখকর হয় না। কাজেই বিশেষ কোনো কৌশল বা উদ্যোগে আমাদের জড়িত হওয়াটা ঠিক হবে না।’

মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান মনে করেন, এ ধরনের কৌশলগত বিষয়ে যুক্ততার ব্যাপারে জাতীয় পরিসরে আলোচনা করে অবস্থান ঠিক করার কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। তবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের নীতিগত অবস্থান ঠিক করা উচিত। চিন্তা করে একটি নীতি ঠিক করতে হবে। কারণ, একটি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমরা একটি ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা ঢুকে গেছি। আর এই ঢুকে যাওয়াটা অনেকটা না বুঝেও হচ্ছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ঠিক করতে হবে, কোন পথে ও কীভাবে বাংলাদেশ এগোবে।