ভোট রেজাউলের, পরীক্ষা নাছিরের

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে কার কর্তৃত্ব থাকবে, তা অনেকটাই ঠিক করে দিতে পারে সিটি নির্বাচন।

আ জ ম নাছির উদ্দীন

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোটের ফলই আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। তবে এই নির্বাচন একই সঙ্গে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের জন্যও বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের প্রার্থীর জয়–পরাজয়ের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও জড়িয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভক্তি, জটিলতা অনেক পুরোনো। সিটি নির্বাচন তা নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। ভোটের পরও এর রেশ থেকে যাবে।

সিটি নির্বাচনের প্রচারণার শুরুতে কিছুটা নীরব থাকলেও কেন্দ্রের কড়া নির্দেশনা পেয়ে আ জ ম নাছিরকে মাঠে তৎপর থাকতে দেখা গেছে। তাঁকে রেজাউল করিমের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে নাছিরের সমর্থকদের নিষ্ঠার বিষয়ে সংশয় রয়ে গেছে রেজাউলের সমর্থকদের।

নাছিরের অনুসারী চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্বাচন থেকে আ জ ম নাছিরের তেমন কিছু অর্জনের নেই। বরং হারানোর শঙ্কা বেশি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারলে দায় পড়বে তাঁর ওপর। আবার রেজাউল করিম জয়ী হলে নাছিরের বিপরীত ধারার রাজনীতি আরও শক্তিশালী হবে। কারণ, এখানকার রাজনীতি তখন মেয়রকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে।

আ জ ম নাছির উদ্দীন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি চট্টগ্রামের সদ্য সাবেক মেয়র। দলে নিজের অনুসারী, লোকবল ও রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় এই নির্বাচনেও মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন পান অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী।

পাঁচ বছর মেয়র থাকা অবস্থায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা পাননি নাছির উদ্দীন। অথচ একই সময় নির্বাচিত ঢাকার দুই মেয়র সাঈদ খোকন ও প্রয়াত আনিসুল হককে সরকার মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেয়। এরপরে বিভিন্ন সিটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত প্রায় সব মেয়রকে প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম হলো, এ নিয়ে দলে নানা আলোচনা আছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হওয়া নিয়েও নানা কথা স্থানীয় রাজনীতিতে রয়েছে।

প্রায় তিন দশক ধরে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। একপক্ষে ছিলেন প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অন্যপক্ষে আ জ ম নাছির। দুই নেতার অনুসারীদের দ্বন্দ্ব কখনো কখনো প্রাণঘাতী রূপ নিত। তিন বছর আগে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পরও বিভক্তি কমেনি। নাছির মেয়র থাকা অবস্থাতেই মহিউদ্দিনের ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পান। পরে তিনি সাংসদ ও উপমন্ত্রী হয়েছেন। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিবুল।

দলে দুটি ধারা সক্রিয় থাকায় এবার কোন ধারার প্রার্থী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পাবেন, সেটা বেশ আলোচিত ছিল। নাছিরের মনোনয়ন না পাওয়ার মধ্য দিয়ে ওই ধারার রাজনীতিকেরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন। দলের মনোনয়ন পাওয়া মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত। এ জন্য উপমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার পরও ভোট উপলক্ষে টানা চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন মহিবুল।

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটি হয়েছিল ২০১৩ সালে। তখন মহিউদ্দিন সভাপতি ও নাছির সাধারণ সম্পাদক হন। মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাওয়ার পর মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে দলের মূল কর্তৃত্ব রয়ে গেছে নাছিরের কাছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। তৃণমূল নেতারা মনে করছেন, নতুন কমিটিতে কার কর্তৃত্ব থাকবে, তা অনেকটাই ঠিক করে দিতে পারে সিটি নির্বাচন।

আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আদর্শের রাজনীতি করেন। দলে তাঁর কর্মী-সমর্থক আছেন। চট্টগ্রামের মানুষ তাঁকে পছন্দ করে। ফলে মেয়রের জয়-পরাজয়ে তাঁর অবস্থান শক্ত বা দুর্বল হওয়ার সুযোগ নেই। দলের বিভক্তি ও নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। দায়িত্বশীল পদে থাকায় দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেটা করছেন।

সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল ভাবনা মেয়র পদ নিয়ে। নির্বাচনে ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৯টিতে কাউন্সিলর পদে ভোট হচ্ছে। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে একটি ওয়ার্ডে ভোট স্থগিত রয়েছে। আর একটি ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের এক কাউন্সিলর প্রার্থী। বাকি ৩৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২টিতেই আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। মেয়রের ভোটে ক্ষতি হতে পারে—এই বিবেচনায় বিদ্রোহী কাউকে বসানোর চেষ্টা করেনি আওয়ামী লীগ। বরং মেয়রের ভোট (আজ বুধবার নির্বাচন) নিশ্চিত করার জন্য সব কাউন্সিলর প্রার্থীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র থাকার সময় মন্ত্রীর পদমর্যাদা না পাওয়া এবং এবার মনোনয়ন হারানোর কারণে দলে আ জ ম নাছিরের অবস্থান নড়বড়ে হয়েছে। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী না হলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এই ধারণা জন্মাবে যে তিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মনে-প্রাণে কাজ করেননি, যা তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলবে। এমনকি নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদও হুমকিতে পড়ে যেতে পারে। আর দলীয় প্রার্থী জয়ী হলে নাছির তাঁর অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন।