মস্তিষ্ক গবেষণায় বড় সাফল্য

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গবেষক সাইফুল ইসলাম। বিভিন্ন দেশের ১৬ জন গবেষকের দলের একজন তিনি। তাঁরা পরীক্ষাগারে মগজের বৃদ্ধি ঘটাতে পেরেছেন। মগজের দুটি ভিন্ন অংশের মধ্যে নিউরনের যে স্থানান্তর হয়, সেটাও তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছেন  l ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গবেষক সাইফুল ইসলাম। বিভিন্ন দেশের ১৬ জন গবেষকের দলের একজন তিনি। তাঁরা পরীক্ষাগারে মগজের বৃদ্ধি ঘটাতে পেরেছেন। মগজের দুটি ভিন্ন অংশের মধ্যে নিউরনের যে স্থানান্তর হয়, সেটাও তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছেন l ছবি: সংগৃহীত

মস্তিষ্ক নিয়ে দুনিয়াজোড়া গবেষণা চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক একটা যুগান্তকারী সাফল্য পেয়েছেন। তাঁরা পরীক্ষাগারে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটাতে পেরেছেন। মগজের দুটি ভিন্ন অংশের মধ্যে নিউরনের যে স্থানান্তর (মাইগ্রেশন) হয়, সেটাও তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছেন। যে প্রক্রিয়াটা আমাদের শরীরের ভেতরে সম্পন্ন হয়, সেটা তাঁরা পরীক্ষাগারে নিজেদের বৃদ্ধি করা মগজে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হন। ব্যাপারটা অভাবনীয় ছিল, অভূতপূর্বও।
এই সাফল্যের অংশীদার বাংলাদেশের গবেষক সাইফুল ইসলাম। বিভিন্ন দেশের ১৬ জন গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত এই দলে তাঁর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গত ২৬ এপ্রিল তাঁদের গবেষণার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক এস পাসকা। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সেই উদ্ভাবনের খবর অন্তত ৫০টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে।
সাইফুল ইসলাম স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনেটিকস ডিপার্টমেন্টে ‘সিঙ্গেল সেল’বিষয়ক গবেষণা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী সুইডেনের ক্যারোলিস্কা ইনস্টিটিউট থেকে পিএইচডি করেন। মস্তিষ্কের দুটি অংশের মধ্যে যে নিউরাল মাইগ্রেশন হয়, সাইফুল ও তাঁর সহযোগীরা সেটি পরীক্ষা করে সত্যতা যাচাই করেন। নিউরাল মাইগ্রেশন যদি কোনো কারণে সঠিকভাবে না হয়, তখনই মস্তিষ্কের নানা ব্যাধি (ব্রেইন ডিজঅর্ডার) দেখা দেয়। তিনি বলেন, এই উদ্ভাবন মস্তিষ্ক গবেষণাকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছে দিয়েছে। এই গবেষণার ধারাবাহিকতা মস্তিষ্কের ত্রুটিজনিত অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা সহজ করে দেবে। মানুষের মস্তিষ্কের মতো সাংঘাতিক জটিল একটি ব্যবস্থাকে হয়তো সত্যি সত্যি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা যাবে।

.
.

গবেষকেরা মস্তিষ্কের এই অংশবিশেষ তৈরি করেছেন স্টেমসেল থেকে। স্টেমসেলগুলো হলো মানবদেহের অসংজ্ঞায়িত কোষ, যেগুলো শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রের নির্দিষ্ট কোষে রূপান্তরিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউরন হলো স্নায়ুকোষ। এই কোষকে নির্দিষ্টভাবে শ্রেণিভুক্ত করা যায়, কিন্তু স্টেমসেলগুলো এমন নির্দিষ্ট করে আলাদা করা যায় না।
মস্তিষ্ক গবেষণার একটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো, মানুষের খুলি খুলে দিনের পর দিন সেখানে কী হচ্ছে, সেটা দেখার সুযোগ নেই। তাই এমন গবেষণার জন্য পরীক্ষাগারে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটানো আবশ্যক। তা ছাড়া মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ আছে। আমরা যখন ভ্রূণ থেকে বড় হতে থাকি, তখন আমাদের মস্তিষ্কও ধীরে ধীরে বড় হয়, পরিপক্ব হয় এবং পূর্ণতা পায়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জটিল যোগাযোগ (নেটওয়ার্ক) তৈরি হয়। তাই এটা গঠনের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মস্তিষ্ক মানবদেহের যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যে হাসি, কথা বলি, কাঁদি, ব্যথা বা কষ্ট পাই, ঘুমাই—এসবের নেপথ্যে মস্তিষ্কের ভূমিকা থাকে। একটা বহুতল ভবনের বৈদ্যুতিক সিস্টেমের যেমন একটি নির্দিষ্ট সুইচবোর্ড থাকে, মস্তিষ্ক বা মগজটাও সে রকম। আমাদের সব রকমের সাড়া কিংবা অনুভূতির অন-অফ সুইচগুলোর স্থান মগজেই।
মানবদেহের অন্যান্য অংশ নিয়ে আমরা যতটা গভীরভাবে জানি, মস্তিষ্ক নিয়ে ততটা এখনো জানি না। এটা শরীরের খুবই জটিল অংশ। মস্তিষ্ক নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষকেরা উঠেপড়ে লেগেছেন পাঁচ-সাত দশক আগে থেকে। তাঁদের স্বপ্ন—এই মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন, এর সব ক্রিয়া-কৌশল উদ্ঘাটন করবেন। তাহলে মানবদেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে আরও দ্রুত। শুধু তা-ই নয়, মানুষের মগজকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলে মস্তিষ্কজনিত বহু সমস্যা ও রোগের সমাধান করা যাবে সহজেই।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার গবেষক।
e-mail: rauful.alam15@gmail.com