মহান মে দিবস আজ, মহামারিতে শ্রমিকের দুর্দিন

পাথর ভাঙার কাজ করে একেকজন শ্রমিক পান দৈনিক ১০০ টাকা। সেই কাজও কোনো দিন জোটে, কোনো দিন জোটে না। করোনার এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা। গতকাল রাজধানীর আমিনবাজার এলাকায়
ছবি: আশরাফুল আলম

প্রায় এক মাস ধরে ‘লকডাউন’ চলছে দেশে। এর বড় শিকার গাড়িচালক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, দোকানদার, ফুটপাতের ছোট ব্যবসায়ী, রিকশাচালক। খেটে খাওয়া কর্মজীবী এই মানুষেরা এখন ঘরবন্দী। সুদিন ফেরার আশায় দিন গুনছেন তাঁরা।

সীমিত পরিসরে পোশাক ও শিল্পকারখানা খুললেও সেখানকার শ্রমিকেরাও আছেন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। সীমিত পরিসরে দোকানপাট খোলা থাকলেও কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। প্রায় একই অবস্থা সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষেরই। এমনই এক কঠিন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস, যা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে পরিচিত। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই দিন তাঁদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিব বর্ষে গড়ব দেশ’।

আজকের আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি হলো শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের নিরলস পরিশ্রম। হাজার হাজার বছর ধরে যে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম-ঘামে মানবসভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, তা থেকে সেই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীই থেকেছে উপেক্ষিত। ঈদুল ফিতরের আগে এবার মহান মে দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। শ্রমিকের অধিকার হচ্ছে তাঁর মজুরি ও বোনাসসহ অন্যান্য সুবিধা। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই স্বাভাবিক সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়টিই অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।

মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মহান মে দিবস পালন উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দিনটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ও টক শো সম্প্রচার করবে।

দাবদাহের মধ্যে ইটভাটায় কাজ করছেন দুজন দিনমজুর। গতকাল যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রোহিতা গ্রামে
ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

এবার করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনশ্রমিকেরা। এক মাস ধরে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ আছে। এই খাতে কাজ করেন প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক। এর বাইরে ইমারত নির্মাণ ও সরকারের বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও করোনার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকেরা। অনেক ভাসমান ক্ষুদ্র দোকানি রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। ফলে তাদের জীবনও অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কৃষি খাতে আছেন ২ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার নারী-পুরুষ। এখন বোরো মৌসুম চলছে। কিন্তু যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে বলে এক অঞ্চলের শ্রমিক অন্য অঞ্চলে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। শিল্প খাতে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ কাজ করে। আর সেবা খাতে আছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। শিল্পকারখানা কিছুটা চালু থাকলেও সেবা খাত করোনার কারণে ভালোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণজনিত মহামারিতে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াল থাবা আঘাত হেনেছে। ফলে গভীর সংকটে পড়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। এ পরিস্থিতিতে সরকার জনগণের পাশে থেকে ত্রাণকাজ পরিচালনাসহ সর্বাত্মক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সরকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তাই কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি সরকারের পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকগণকেও শ্রমজীবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেছেন, মহান মে দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। এই ঐতিহাসিক দিনে তিনি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সব মেহনতি মানুষকে শুভেচ্ছা জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সরকার শ্রমজীবী মানুষের পাশে থেকে ত্রাণ বিতরণসহ সর্বাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকার সংকট মোকাবিলায় শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।’