মাঝেমধ্যেই নিখোঁজ হচ্ছে সুন্দরবনের ‘বাহাদুর’

নিখোঁজ হওয়ার গল্প গোপন রাখে সুন্দরবনের বাহাদুরছবি- সংগৃহীত

বাহাদুর মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যায়। নদী থেকে পানি নিয়ে এখনই ফিরছি বলে মাসখানেকের জন্য নিরুদ্দেশ। খেলতে যাচ্ছি বলে মাস দু-এক লাপাত্তা। আবার একদিন অন্ধকার রাতে সুতারখালী আর শিবসার গায়ে যখন গোলপাতার ঝুলন্ত ঘরগুলোর মধ্যে অন্ধকার জমাটবদ্ধ হয় তখন ছোট ছোট দুই পা এসে থামে ভদ্রার পাড়ে। গোলপাতার ছায়ার ভেতর দেখা যায় অপুষ্ট অথচ উজ্জ্বল চোখের এক মানবশিশুর অবয়ব।

ফেরার টানে উতলা হলে গুনারী হয়ে শিবসার ধারে দাঁড়ায় সে। রাত ফুরানোর আভাস মাত্রই উঠে বসে লাইনের ট্রলারের কাঁকড়া বা মাছের রেণুবোঝাই হাঁড়ি থেকে ছলকে আসা পানিমাখা ভেজা পাটাতনে। বাহাদুরের বাড়ি খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গ্রাম ফকিরকোনায়। লাইনের ট্রলার যায় না এতখানি পথ। কালাবগী বাজারের ঘাট থেকে আবার অপেক্ষা কোনো ডিঙিনৌকার জন্য। বাহাদুর অবশ্য চাইলে সাঁতরেও যেতে পারে এ পথটুকু।

নিজের নামের কৌলীন্যের তেজ থাকে মানুষের। ‘বাহাদুর’ নামটা তো পাড়াপড়শির কাছ থেকে পাওয়া। আসল নাম ‘তরিকুল শেখ’, যাঁর বয়স এখনো দশের ঘরে। নতুন নাম পাওয়ার পেছনের মাহাত্ম্য অক্ষুণ্ন রাখা আবশ্যক। তবে এ বয়সেই এমন বৈরাগ্যের হেতু জানতে চাইলে হেসে বলে, ফিরতে মন টানে না। মন যে কেন টানে না, সে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো বয়স তো এখনো ওর হয়নি।

তরিকুল আসলে মা হারানো, বাপে তাড়ানো, স্কুল পালানো এক শিশু। অথচ বছর দেড় আগেও ওর গল্পটা এমন ছিল না। অভাব থাকলেও কাঁকড়া আর মাছ ধরে ওর বাবা যে উপার্জন করতেন, তা দিয়ে একটি যৌথ পরিবারের বন্ধন ছিল গোলপাতার ঘরে। ভাটায় নামলে ওর মা মমতাজের ছোট জালে কখনো কখনো উঠে আসত দাঁতিনা বা গনগনে মাছও। সেদিন তরিকুলের পাতে গরম ভাতের আনন্দ।

২০২০ সালের ২১ মে দুপুরে বাতাস ছুটলে আতঙ্কিত গ্রামবাসীর মুখে মুখে ছড়াচ্ছিল, শিবসা-সুতারখালীর কোলে দোল খাওয়া ফকিরকোনা এবার কালাবগী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। বাস্তবে নদী আর ঝড়ের দাপট ছিল আরও ভয়াবহ। স্থলপথের সঙ্গে এ গ্রামের শেষ সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে সে ঝড়ে। পাশের ঘরের রিনা বেগম আতঙ্ক নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে তরিকুলের মাকে বলছিলেন, নদী আরও বড় হয়েছে। এবার হয়তো বাঁচার সুযোগও পাবে না ফকিরকোনার মানুষ। এর মধ্যে জোয়ার এলে টেনে নিয়ে গেল শিবসার দিকের কয়েকটি ঘর।

ভাঙন নয়, যেন চোখের সামনে নদীতে আত্মাহুতি দিল ওদের প্রতিবেশীদের বসতবাড়ি। মৃত্যুর আতঙ্ক সামলাতে না পেরে অপুষ্ট শরীরের তিন সন্তানের মা মমতাজ মৃত্যুর কাছেই পরাস্ত হলেন। ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করলেন। শিশু তরিকুল চোখের সামনে দেখল, ঝড় থেকে ঘর নিস্তার পেলেও মুহূর্তে নাই হয়ে গেল ঘরে থাকার সবচেয়ে আপনজন।

ফকিরকোনায় টিকে থাকা অল্প কয়েকটি ঘর
ছবি- সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

তরিকুলের পিঠাপিঠি বোন মঞ্জিলার বয়স তখন মোটে ১১ বছর। সবার বড় ভাই আর বাবা আছে এ রক্ষা। কিন্তু আদতে রক্ষা হলো না কিছুই। এক মাসের মধ্যে তরিকুলের বাবা বিয়ে করে খুলনা শহরে চলে গেলেন নতুন স্ত্রীকে নিয়ে। বছরে ছয় মাস ইটভাটায় কাজ করতে যাওয়া বড় ভাই বিয়ে করে পৃথক হলেন। গোলপাতার সেই পারিবারিক বন্ধন এবার ছিন্ন হলো সত্যি সত্যি।

ঝড়ের পর ফকিরকোনা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেখানে সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ কিছুই পৌঁছাল না এখন পর্যন্ত। চিকিৎসাসেবা নেই, বিদ্যালয় নেই সুন্দরবনঘেঁষা এই দ্বীপ গ্রামে। স্থানীয় সংগঠন ‘শিশুদের জন্য আমরা’র উদ্যোগে শুরু হলো ‘আমাদের স্কুল’। আম্বিয়া বেগম নামের একজন মাত্র শিক্ষক সব শিশুকে পড়ান। আয়োজকেরাই বিনা বেতনে তরিকুলকে ভর্তি করে দিলেন স্কুলে। কিন্তু তরিকুলই হলো স্বঘোষিত ক্যাপ্টেন। স্কুল থেকে শুরু করে ফকিরকোনার যেকোনো খবর মুখস্থ রাখে। কেউ এলে সবার হাঁড়ির খবর বলে দিতে পারে গড়গড় করে। অন্য শিক্ষার্থীরা যখন সংকোচে নিজেকে গুটিয়ে রাখে, তরিকুল তখন সবার আগে আগে হাঁটে। অন্যের সমস্যা নিয়েও ওর বিস্তর মাথাব্যথা।

সবুজ আর গোলাপি জামা গায়ে সহপাঠীর পেছনে খুদে বাহাদুর
ছবি- সংগৃহীত

একই রকম অন্যের মুখে আনন্দ দেখে যে নিজেরই আনন্দ হয়, তা বুঝে ফেলেছে এটুকু বয়সেই। দেখা-না দেখা সব গল্প সে বানিয়ে বলেও মুগ্ধ করার চেষ্টা করে অন্যদের। হয়তো হঠাৎ ওর মনে হলো, ডলফিনের গল্প শুনলে মানুষ খুশি হবে। বলে দিল তাঁকে, এই নদীতে সবচেয়ে বড় ডলফিন দেখেছে নিজে। অথবা কাউকে বিস্মিত করার জন্য জানিয়ে দিল, এই সেদিন ও না থাকলে অমুককে কুমির গিলেই নিয়েছিল। যেন টানাটানি করে সে নিজেই কুমিরের মুখ থেকে টেনে বাঁচিয়েছে। তরিকুলের এই সব গল্প শুনে স্নেহশীল জ্যেষ্ঠরা বুঝতে পারে, মনের ভেতরে অন্য কোনো বেদনার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে শিশু নিজেই নিজের। তারা অবাক হওয়ার ভান করে।

প্রশ্রয়ে তরিকুল কখনো কখনো প্রায় ডুবে যাওয়া খেলার মাঠে ফুটবলে একটা গোল দিয়ে আত্মহারা হয়ে গড়াগড়ি দেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে নিজেকে ম্যারাডোনা দাবি করে বসে। আসলে সে অসীম ওই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে কল্পনায় মৃত মায়ের কাছ থেকে সার্টিফিকেট আদায় করে কি না সে কথা তরিকুল কখনো ব্যাখ্যা করে না। সামান্য স্নেহ পেলেই বয়সে ঢের বড় কাউকে বলে বসে, আপনার গগলসটা (রোদচশমা) দেবেন? চোখে দিলে সব রঙিন লাগে? ওর অকপট সরল উৎফুল্লতার সঙ্গে যুক্ত হয় সম্ভবকে অসম্ভব করার নানা গল্প।

ফকিরকোনা থেকে সুন্দরবন কয়েক মিনিটের দূরত্ব
ছবি- সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সুন্দরবন–সংলগ্ন সবচেয়ে কাছের জনবসতিগুলোর একটি এই ফকিরকোনা। ভাটার সময় চাইলে হেঁটেই চলে যাওয়া যায় বনে। জোয়ারে সাঁতরালে বড়জোর ১০ মিনিট। তরিকুল বনের সব গাছ চেনে। অলিগলি, খাঁড়ি, নালার মানচিত্র মুখস্থ। বাড়ির দুপাশে উপচে ওঠে দুই নদী। সুতারখালী বা শিবসা যেকোনোটি ধরে কয়েক মিনিট সাঁতার কাটলেই রহস্যময় সেই বাদাবন। এই বিপুল অরণ্যের স্তব্ধতা দুদণ্ড শান্তি দেয় শিশু তরিকুলকে। মাঝেমধ্যেই সে বনের কাছে আত্মসমর্পণ করে একা একাই ঘুরে বেড়ায়।

অথচ বয়স এখনো ১০ ফুরায়নি শিশুর। খিদেয় পেট বসে থাকে প্রায়ই। মায়ের স্মৃতি মনটাকে পুড়িয়ে খাক করে অথচ মুখের হাসি অক্ষত। সেই হাসিমাখা আনন্দ উজ্জ্বল মুখ আর দুঃসাহসিক সব অভিযানের জন্য ওর নাম দেওয়া হয় বাহাদুর। নাম হিসেবে না নিয়ে সে যেন খেতাব হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই বাহাদুর পরিচয়ে সাহস বেড়েছে লাফিয়ে। অপুষ্ট শরীরের এই শিশুর শরীরের বৃদ্ধিটা এলোমেলো কিন্তু সংবেদনশীলতায় একের পর এক আঘাতে মানসিক পরিণত ভাবটা খুব বেশি। তরিকুল জানে, না ফিরলে উদ্বিগ্ন হওয়ার মানুষ কেউ নেই তাই সে হারিয়ে যায় প্রায়ই।

কালাবগীর ফকিরকোনায় এমন এক ঘরেই আম্পান ঝড়ে মৃত্যু হয় বাহাদুরের মায়ের
ছবি- সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

এই দীর্ঘ সময় ধরে পর্যটক হয়ে থাকা তো বিনা পয়সায় অসম্ভব। ছোট মুখে একটা চওড়া হাসি দিয়ে জানায়, ছোট মানুষ বলে অন্যদের মতো এত টাকা ওর লাগে না। বাসে, ট্রেনে তো সে আর টিকিট কেটে ঘুরে বেড়ায় না। হয় ইঞ্জিনের সিটটায় বসে অথবা দরজা ধরে চারপাশ দেখতে দেখতে বাতাস লাগায় গায়ে।

এভাবে কয়েক দফা নিখোঁজ হয়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার পর্যন্ত ঘুরে এসেছে এই বাহাদুর। কখনো কোনো হোটেলে কয়েক দিন সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আবার মন ছুটলে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছায় খুলনা রেলস্টেশনে। মায়ের জন্য হাহাকারটা মুখের হাসি দিয়ে ঢেকে রাখতে সে দক্ষ হয়ে উঠেছে দেড় বছরে। বেশি কষ্ট হলে কালাবগীর ফকিরকোনার জলমগ্ন গোলপাতার ঘরে ফেরার আগে একবার দেখে যায়, নতুন পরিবারসমেত খুলনানিবাসী বাবাকে। তারপর আবার লঞ্চ বা নৌকায় উঠে একটু একটু করে এগিয়ে আসে ভদ্রা হয়ে সুতারখালীর কাছে।

হাসিমুখের শিশু বাহাদুর ইচ্ছা হলেই আবার হয়তো নিখোঁজ হবে
ছবি- সংগৃহীত

এই নদী ওর মাকে নিয়েছে, উল্টেপাল্টে দিয়েছে পারিবারিক বন্ধন। আম্পানের মতো সব ঝড়কে সে ঘৃণা করে ভীষণভাবে। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতির যে হিসাব হয়, তাতে কখনো স্থান পায় না মানবিক বিপর্যয়ের গল্প। ২০২০ সালের মে মাসে ‘আম্পান’ ঝড়ের পর থেকে আদতে বাস্তবতার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো এক শিশুর নাম বাহাদুর। ঝড় আর জলোচ্ছ্বাস, বন আর নদীতাড়িত জীবনের সে শুধু একটা চিহ্ন।