মাটির থালাবাসনের কদর দামি রেস্তোঁরায়

.
.

ইটপাথরের দালানকোঠার ভিড়ে জরাজীর্ণ টিনের বাড়ি। ভেতরটা আরও অগোছালো। অন্ধকার। লম্বা ঘরটায় অনেকগুলো ভাগে সাজানো মাটির তৈরি জিনিসপত্র। প্রতি ভাগেই দুটি স্তর। ওপর-নিচে থরে থরে সাজানো থালা, বাসন, হাঁড়ি, পাতিল, ঘটিবাটি, ব্যাংক, টব, প্রদীপদানি, ঢাকনাসহ বহু জিনিস।

ঘরটির ভেতরে প্রবেশ করলে পোড়ামাটির গন্ধমাখা এক অন্য আবেশ। মাটির গন্ধ, মাটির স্বাদ, মাটির স্পর্শ। চারদিকে শুধু মাটি। মাটির তৈরি সব জিনিস। লম্বাকৃতির ঘরটার একটু একটু ভেতরে যাওয়া মানে যেন আধুনিক যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে ধীরে ধীরে ফেলে আসা অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এমন আবেশ মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারের মন্দিরের বিপরীতে গোসাই পালের মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকানে পাওয়া যায়। এটি তাঁর তিন পুরুষের ব্যবসা বলে জানালেন। বর্তমানে অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও টিকিয়ে রেখেছেন।

গোসাই পাল বলেন, এখন যেখানে তাঁর দোকানটি টিকে আছে, আগে সেটাই ছিল কারখানা। এখানেই একসময় কারিগরেরা তৈরি করতেন মাটির জিনিস। হাঁড়ি, কড়াই, বদনা, ঢাকনা, ফুলের টব, কলস, পিঠার ছাঁচ, মুড়ি ভাজার সামগ্রী। কিন্তু নগরায়ণের ফলে কারখানা সেখান থেকে উঠে গেছে। নির্মিত হয়েছে দালানকোঠা, সুরম্য অট্টালিকা। তাই এখন শহরের বাইরে থেকেই জিনিস তৈরি করে আনতে হয়। কারিগরেরা ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। ফরমাশ নিয়ে যান।

জিনিস তৈরির ফরমাশ নিতে সাভারের ধামরাই থানার কাগজীপাড়ার হাজীপুর গ্রামের দুই কারিগর এসেছেন—মদন পাল ও অরুণ পাল। কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। অরুণ পাল বলেন, ‘মাটির কাজে এখন আর লাভ নাই। সবাই এই পেশা ছাইড়া দিতাসে। আমরা অন্য কোনো কাজকাম জানি না। তাই বাপ-দাদার পেশা কোনো রকমে আঁকড়ে ধরে আছি।’

ধামরাইয়ের পালদের দক্ষতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যেকোনো জিনিসের নমুনা নিয়ে আসেন, আমরা মাটি দিয়ে সেটি তৈরি করে দিব।’ এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরমাশের কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো যে নমুনা দেয়, তাঁরা সেগুলো তৈরি করে দেন।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারিক বস্তু হিসেবে মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার করতেন। একসময় মাটির তৈরি জিনিস রাজা, জমিদার ও অভিজাত পরিবারে ব্যবহৃত হতো। কালক্রমে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। কম দামে বেশি টেকসই প্লাস্টিক, মেলামিন, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দাপটে মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে গেছে। ফলে মৃৎশিল্পই হারিয়ে যাওয়ার পথে।

কুমারেরা তাঁদের দক্ষতা ও মনের মাধুর্য দিয়ে চোখজুড়ানো কারুকাজ করে থাকেন। নকশা করা হাঁড়িপাতিল, চাড়ি, বদনা, থালা, ফুলের টব, ফুলদানি, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, সাজসজ্জা, অলংকারসহ বাংলার চিরাচরিত সব নিদর্শন উঠে আসে তাঁদের মৃৎশিল্পে।

এই শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আশপাশে ভালো মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক দূর থেকে মাটি আনতে হয়। তা ছাড়া জ্বালানির দাম বেশি। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, বাজারজাতে ত্রুটি, পরিবহন-সমস্যা নানাবিধ সংকট রয়েছে এই শিল্পে। ফলে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে এখন কৃষি, মাছ চাষ, রিকশা-ভ্যান চালানোসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন।

তবে অনেক শিল্পসচেতন ব্যক্তি ইদানীং মৃৎশিল্পের কদর করছেন। তাঁদের চাহিদায় শৌখিনতার অনুষঙ্গ হচ্ছে মাটির এসব পাত্র। মাটির তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে ঘর সাজিয়ে তুলছেন অনেকে। প্রশংসাও মিলছে বেশ। এ ছাড়া নামীদামি খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁগুলোতে মাটির অনেক জিনিস ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব কুমার দিয়ে নতুন নতুন নকশার এসব জিনিস তৈরি করছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে মাটির তৈরি এসব জিনিস। রাজধানীর অনেক স্থানে ফুটপাতেও বিক্রি হয় মাটির এই জিনিসগুলো। সেখানে পেতে পারেন পোড়ামাটির গন্ধ।