মাটির ব্যাংকে টিনের ঘর চলে সংসার

গ্রামের সাধারণ মানুষ বাণিজ্যিক ব্যাংকে টাকা রাখতে না পারলেও মাটির তৈরি ব্যাংকে টাকা-পয়সা জমায়। একসময় ভরে গেলে ব্যাংকটি ভেঙে জমানো টাকা গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগায়। সেই মাটির ব্যাংক তৈরি করেই গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ঢালজোড়া ইউনিয়নের উল্টাপাড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারের সংসার চলে। ১৫ বছর ধরে এটিই তাদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।একসময় গ্রামের দু-একটি পরিবার মাটির ব্যাংক তৈরির কাজ করত। হাতে কাজ না থাকায় তাদের দেখে এবং তাদের কাছ থেকে বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সাত-আট বছর আগে গ্রামের চঞ্চল চন্দ্র পাল এ কাজ শুরু করেন। তিনি এ জন্য একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সহযোগিতার হাত বাড়ান তাঁর স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আগে এক বেলা খেলে আরেক বেলা খেতে পারতাম না। আর এখন সংসারে কোনো অভাব নেই। একটি টিনের বাড়ি করেছি; ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াচ্ছি।’যেভাবে শুরু: প্রায় ১৫ বছর অগে ওই গ্রামের দিনু পাল সাভারের একটি বিদেশি মৃিশল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানে মাটি দিয়ে ব্যাংক, ফুলদানি, ফুলের টব, বসার মোড়াসহ নানা রকমের খেলনা তৈরি করা হতো। পরবর্তী সময়ে গ্রামের বেকার কয়েকজন যুবকের উত্সাহে দিনু পাল আট হাজার টাকা ধার করে একটি হুইল মেশিন (ব্যাংক তৈরির জন্য মাটি উপযোগী করার যন্ত্র) কিনে বাড়ির উঠানে বসান। শুরু হয় দিনু পালের ব্যাংক তৈরির কাজ। তাঁকে দেখে গ্রামের অনেক বেকার এ কাজ শুরু করেন। দিনু পাল তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন বিনা পয়সায়। এভাবে পুরো গ্রামেই পরিচিত হয় মাটির ব্যাংক তৈরির কাজ।যেভাবে তৈরি হয়: গ্রামের পাশের খাল থেকে মাটি এনে বেশ কয়েক দিন চাপা দিয়ে রাখা হয়। মাটি শুকিয়ে গেলে তা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে হাত ও পায়ের সাহায্যে আঠালো করা হয়। সেই মাটি পা-চালিত হুইল মেশিনের ওপর রেখে হাতের মাধ্যমে ডিজাইন করে তৈরি করা হয় ব্যাংক। ব্যাংক তৈরির পর তা কায়েক দিন পর্যন্ত রোদে শুকাতে হয়।বাজারজাত: বিভিন্ন আকারের ব্যাংকের দাম ভিন্ন। যেমন—ছোট ব্যাংকের পাইকারি দাম চার টাকা, বড়গুলোর দাম সাড়ে চার টাকা। প্রথম দিকে কারিগরেরা নিজেরাই উপজেলার বিভিন্ন বাজারসহ ঢাকায় নিয়ে ব্যাংক বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে মহাজনেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাংক কেনা শুরু করেন। ব্যাংকের পাইকার সোনিল জানান, গ্রামে অনেকের পুঁজি নেই; অনেক সময় তাঁদের ঋণ দিয়ে সহাযোগিতা করা হয়। ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত কোনো সুদ দিতে হয় না, তবে প্রতিটি ব্যাংকে ৫০ পয়সা দাম কম দেওয়া হয়।ঢালজোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কুদ্দুস আলী বলেন, যাঁরা এ কাজে জড়িত তাঁরা সহজ শর্তে সরকারি ঋণ পেলে ব্যবসা আরও প্রসারিত করতে পারতেন। চেয়ারম্যান মো. ইছামুদ্দিন বলেন, ‘উল্টাপাড়া গ্রামে গেলে মন ভরে যায়। সবাই কাজে ব্যস্ত, কেউ ব্যাংক তৈরির হুইল ঘুরাচ্ছেন, কেউ কাঁচা ব্যাংক রোদে শুকাচ্ছেন। ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামে বেকার সমস্যা থাকলেও ওই গ্রামে বেকার খুঁজে বের করা কঠিন।’