মাশরুম চাষের দিকপাল বাবুল

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপনের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পদক পেয়েছেন বাবুল আক্তার।

মাগুরা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ি গ্রামে অবস্থিত বাবুলের ড্রিম মাশরুম সেন্টারছবি: প্রথম আলো

দারিদ্র্যের কারণে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। রয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধিতাও। তবে মাশরুম চাষ করে ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। শূন্য থেকে শুরু করে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পদক।

সংগ্রামী ও অনুপ্রেরণার এই গল্প মাগুরা সদর উপজেলার বড়খড়ি গ্রামের উদ্যোক্তা বাবুল আক্তারের (৩৩), যিনি মাশরুম চাষের মাধ্যমে নিজ এলাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।

মাগুরা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মঘী ইউনিয়নে বড়খড়ি গ্রামের অবস্থান। সেখানেই অবস্থিত বাবুলের ড্রিম মাশরুম সেন্টার। তাঁর সাফল্যে বড়খড়ি গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে ‘মাশরুম ভিলেজ’ হিসেবে, যেখানে উৎপাদিত মাশরুম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা চলছে। বাবুলের ড্রিম মাশরুম সেন্টারে সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছে ডিএমসি ল্যাবরেটরিজ নামে ইউনানি আয়ুর্বেদিক ওষুধের ব্যবসা, যেখানে তৈরি হচ্ছে ৮৪ ধরনের আয়ুর্বেদিক ওষুধ। মাগুরায় উৎপাদিত এই ওষুধ এখন চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাবুলের হিসাবে এই উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁর ব্যবসার মূলধন ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় ৪০ লাখ টাকার ওপরে। বাবুলের নেতৃত্বে সারা দেশে কাজ করছেন পাঁচ শতাধিক কর্মী।

তবে বাবুলের শুরুর পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। তাঁর বাবা আবুল হাসেম ছিলেন আনসার ভিডিপির ইউনিয়ন লিডার। ৯ ভাইবোনের মধ্যে বাবুল অষ্টম। চাষের জমিজমা ছিল না। বাবার স্বল্প বেতনে কোনোরকমে চলত সংসার। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শেষ হয় বাবুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাট। লেগে পড়েন সংসারে আয়বর্ধক কাজে। মাশরুম চাষ শুরুর আগে বাবুল কিছুদিন মাগুরা শহরে এক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন।

মাশরুম নিয়ে বাবুলের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। মাগুরা শহরে চিকিৎসকের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করার সময় প্রথম জানতে পারেন মাশরুম চাষ সম্পর্কে। ওই চিকিৎসক তাঁকে নিয়ে যান যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টারে। সেখানে তিন দিনের মাশরুম চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েই হাতেখড়ি। প্রশিক্ষণ শেষে বিনা মূল্যে পাওয়া ১০টি মাশরুমের বীজ দিয়ে ১০০ বর্গফুটের ঘরে চাষ শুরু করেন তিনি। আগ্রহ বাড়তে থাকে বাবুলের। শুরুর দিকে দিনে এক থেকে দেড় কেজি মাশরুম উৎপাদিত হতো, যেটা স্থানীয় বাজারে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন বাবুল নিজেই। তখন সব কাজ এক হাতেই করতে হতো তাঁর।

২০০৮ সালে মাগুরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সমন্বিত কৃষি প্রশিক্ষণেও মাশরুম চাষ সম্পর্কে ধারণা পান বাবুল আক্তার। একই বছরে সাভার মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে দুই মাস মেয়াদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাশরুম চাষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। এরপর মাশরুমের বীজ উৎপাদন শুরু করেন বাবুল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মাশরুমের চাষ। ধাপে ধাপে বড়খড়ি গ্রামে গড়ে ওঠে বাবুলের ড্রিম মাশরুম সেন্টার। ২০১২ সালে এসে এখানে মাশরুমের মাদার কালচার উৎপাদন শুরু হয়। এরপর জেলাভিত্তিক মাশরুমের বিপণন শুরু করেন বাবুল। ওই সময়ে মাগুরা জেলায় ১০০ থেকে ১৫০ জন মাশরুম খামারি তৈরি হয়। তখন মাসে সাত থেকে আট লাখ টাকার মাশরুম বিক্রি হতো।

২০১৫ সালে এসে নিজস্ব ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে গ্যানো মাশরুম উৎপাদন শুরু হয় ড্রিম মাশরুম সেন্টারে। তখন সারা দেশে ৩০০ থেকে ৪০০ মাশরুমচাষি তৈরি হয় বাবুলের নেতৃত্বে। মাসে গড়ে ৩০ লাখ টাকার মাশরুম বিক্রি হতো।

সম্প্রতি বড়খড়ি গ্রামের ড্রিম মাশরুম সেন্টারে কথা হয় বাবুল আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০২০ সালের শেষের দিকে ইউনানি ওষুধ তৈরির নিবন্ধন পেয়েছেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি শুরু হয় উৎপাদন, যেখানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে ১২০ জনের মতো কর্মী কাজ করছেন। আর সারা দেশে তাঁর বিপণনকর্মী রয়েছেন পাঁচ শতাধিক।

বড়খড়ি গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, অনেক বাড়িতে মাশরুমের চাষ হচ্ছে। তাঁদের অনেকেরই ভাগ্য বদলেছে মাশরুম চাষে।

বাবুল আক্তার চলতি বছরের ১ নভেম্বর শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠক হিসেবে জাতীয় যুব পদক পেয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপনের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ও একই বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পদক পান বাবুল আক্তার।

প্রথমবার মাশরুম সম্পর্কে বাবুল প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মো. আখতারুজ্জামানের কাছে। ওই কর্মকর্তা তাঁর লেখা অধিক পুষ্টি ও ঔষধি গুণসম্পন্ন সবজি মাশরুমের পূর্ণাঙ্গ গাইড বইয়ে বাবুল আক্তার সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি হাজারো মানুষকে মাশরুম চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তবে বাবুলের মতো সফল কেউ হতে পারেনি। উদ্যম, আগ্রহ, দৃঢ় মনোবল ও অসীম ধৈর্যসহকারে কাজ করলে যে সফলতা মানুষের কাছে ধরা দেয়, তার উদাহরণ বাবুল আক্তার।