পর পর চার মেয়ের পরে দুই ছেলে। তাই তাঁরা পেতেন বাড়তি আদর ও ভালোবাসা। দুই ছেলের যত্নের জন্য বাবা দুজন কাজের মানুষও রেখেছিলেন। অসময়ে বাবা মারা গেলেও মা তাঁদের অযত্নে রাখেননি। সেই আদরের দুই ছেলে বড় হতেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। পরে বড় ছেলে খোকন (৩২) ও ছোট ছেলে রিপনকে (২৫) পুলিশে দেন মা নূর বানু। কারাগারে খোকন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বের করে আনেন নূর বানু। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার রাতে খোকন মারা যান।
নূর বানুর বাড়ি রাজশাহী নগরের তালাইমারী এলাকায়। তিনি বাংলাদেশ বেতারের একজন কর্মচারী। তাঁর স্বামীও বেতারে চাকরি করতেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নগরের সাহেব বাজারে ওই দুই সন্তানকে কাপড়ের দোকান করে দিয়েছিলেন নূর বানু। দুই ভাই ওই ব্যবসা শেষ করে দেন। পরে নূর বানু তাঁদের একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনে দেন। ওটাও তাঁরা শেষ করে দেন। পরে দুই ভাই বেকার হয়ে যান। এর মধ্যে তিনি বড় ছেলেকে বিয়ে করান। তাঁর একটা ছেলে রয়েছে। স্ত্রীও অন্তঃসত্ত্বা।
অটোরিকশা বিক্রি করার পর নূর বানু বুঝতে পারেন দুই ছেলেই মাদকাসক্ত। প্রতিদিন সকালে দুই ভাই মায়ের কাছে ১২০ টাকা করে দাবি করেন। টাকা না দিলেই বাড়িতে ভাঙচুর করেন। গত এপ্রিল মাসে খোকন তাঁর ছেলের মুসলমানির জন্য রাখা ছাগলটিও বিক্রির চেষ্টা করেন। কোনো উপায় না দেখে মা তাঁকে পুলিশে দেন। সপ্তাহ খানেক আগে হাজতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বের করে আনা হয়।
এদিকে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে রিপনের কান্নাকাটি দেখে মা তাঁকে হাজত থেকে ছাড়িয়ে আনেন। তাঁকে এখন প্রতিদিন নেশার জন্য ১২০ টাকা করে দিতে হয়। না দিলেই বাড়িতে ভাঙচুর চালান ও পরিবারের সদস্যদের মারধর করেন। দিশেহারা হয়ে তাঁকে আবারও পুলিশে দেওয়ার জন্য গত তিন দিন আগে নগরের বোয়ালিয়া থানায় আবেদন করেন নূর বানু।
গত বৃহস্পতিবার রাতে মাদক সেবন করতে গিয়ে খোকন পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি যেতে চাননি। এ সময় খোকন বলেন, ‘চিকিৎসকের কাছে গেলে টাকা লাগবে। কোনো কাজ হবে না। তোমরা মওলানার কাছ থেকে পড়া পানি এনে দাও।’ পানি খেয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। রাতের ঘুমের ভেতরেই তাঁর মৃত্যু হয়।
গতকাল শুক্রবার তাঁদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নূর বানু ছেলের জন্য বিলাপ করছেন। তিনি বারবার বলছেন, ‘নেশা আমার আদরের ছেলেকে কেড়েই নিল।’ এ সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই ছেলেকে হাজতে পাঠিয়ে তিনি পথে পথে কেঁদে বেরিয়েছেন। এ কারণে তাঁদের দেখতে গিয়ে ওদের কান্না দেখে আবার বের করে আনেন। আর সাত মাস পরই তিনি চাকরি থেকে অবসর নেবেন। অবসরকালীন যে আর্থিক সুবিধা পাবেন তা দিয়ে দুই ছেলেকে আবারও ব্যবসা দিতে চেয়েছিলেন। এখন কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।
এ সময় খোকনের স্ত্রী নাসরিন বেগমকে নির্বিকার হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না।