মীর কাসেমের যত অপরাধ
মুক্তিযুদ্ধকালে ঈদুল ফিতরের পর যেকোনো একদিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যান। তাঁর নির্দেশে জসিমকে সেখানে আটকে রেখে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত আলবদর সদস্যরা নির্যাতন করেন। নির্মম অত্যাচারে জসিম মারা যায়। পরে নিহত আরও পাঁচজনের সঙ্গে জসিমের মরদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে এটি ছিল ১১ নম্বর অভিযোগ। এই অভিযোগে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড ট্রাইব্যুনালে ও আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে বহাল থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম হত্যায় পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে গত রাতে।
জামায়াতের এই নেতা ১৯৭১ সালে ছিলেন দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান। তাঁর নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা এলাকার ডালিম হোটেলে স্থাপিত হয় আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র। একাত্তরে চট্টগ্রামে এই ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন মীর কাসেম আলী। এর ফলে ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় হত্যাপুরী হিসেবে। আর মীর কাসেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম হত্যাসহ দুটি অভিযোগে (১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ) মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড ও অপর আট অভিযোগে (২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর) বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেন। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগে সাত বছর করে কারাদণ্ড, একটি অভিযোগে ২০ বছর ও অপর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর চারটি অভিযোগ (১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর) প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হওয়ায় সেসব অভিযোগ থেকে খালাস পান তিনি।
পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ডালিম হোটেলের আলবদর ক্যাম্প ছিল সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু। সব আটক, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা এখানেই ঘটেছে। এখানে বন্দীদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন করা হতো। অনেকেই এই নিদারুণ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন...। এই ডালিম হোটেলের নিয়ন্ত্রক ছিলেন মীর কাসেম আলী। তাঁর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ডালিম হোটেল পরিচালিত হতো। ট্রাইব্যুনালের অভিমত, একাত্তরে ডালিম হোটেল পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হয়, মীর কাসেম ছিলেন যার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে মীর কাসেম আলীর করা আপিলের ওপর গত ৮ মার্চ রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। মীর কাসেমের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ৪, ৬ ও ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ১২ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছিল। আর ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে আপিল নাকচ করে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত।
ছয়টি অভিযোগ
অভিযোগ-২: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ নভেম্বর দুপুর দুইটার দিকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনী লুতফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে চাক্তাই এলাকার বকশিরহাটে জনৈক সৈয়দের বাড়ি থেকে অপহরণ করে। এরপর তাঁদের আন্দরকিল্লার মহামায়া হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে লুতফর রহমান ফারুককে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের কর্মীদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফারুককে আরও দু-তিন দিন ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাঁকে সার্কিট হাউসে নিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয় আলবদর। সেখানেও তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয় এবং চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে সেখান থেকে ছাড়া পান ফারুক।
এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদণ্ড আপিল বিভাগ বহাল রাখেন।
অভিযোগ-৩: ওই বছর ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ডবলমুরিং থানাধীন কদমতলীতে তাঁর বাসা থেকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা। তাঁকে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে মীর কাসেমের উপস্থিতিতে নির্যাতন চালানো হয়। দেশ স্বাধীন হলে ১৬ ডিসেম্বর সকালে ডালিম হোটেল থেকে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করেন তাঁর আত্মীয় ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকেরা।
ওই ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাত বছরের কারাদণ্ড আপিল বিভাগ বহাল রাখেন।
অভিযোগ-৭: একাত্তরের ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পর মীর কাসেমের নির্দেশে ডবলমুরিং থানাধীন ১১১ উত্তর নলাপাড়া থেকে মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যান আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে তাঁদের আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। মীর কাসেমের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ নির্যাতন কেন্দ্রে আটক থাকার সময় তাঁরা আরও অনেককে আটক অবস্থায় দেখতে পান। এঁদের অনেককে আবার ডালিম হোটেল থেকে নিয়ে যেতে দেখেন তাঁরা, এবং পরে শুনতে পান যে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের মেরে ফেলেছেন।
এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাত বছরের দণ্ড বহাল থাকে আপিল বিভাগে।
অভিযোগ-৯: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২৯ নভেম্বর ভোরে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে চাঁদগাঁও থানাধীন নাজিরবাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ চাচাতো ভাইসহ নুরুজ্জামানকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যান আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। সেখানে তাঁদের আটকে রেখে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে তাঁদের সেখান থেকে মুক্ত করা হয়। এই ঘটনায় মীর কাসেম আলীকে দেওয়া সাত বছরের দণ্ড আপিলে বহাল থাকে।
অভিযোগ-১০: একাত্তরের ২৯ নভেম্বর ভোর পাঁচটার দিকে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা নাজিরবাড়ি এলাকা ঘেরাও করে মো. জাকারিয়া, মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া, ইস্কান্দর আলম চৌধুরী, মো. নাজিম উদ্দিনসহ আরও অনেককে অপহরণ করে এবং এনএমসি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যান। পরে তাঁদের সবাইকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। বয়সে ছোট হওয়ায় নাজিমুদ্দিনকে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়। সাত-আট দিন পর মো. জাকারিয়াকে, ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বর মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবশেষে ইস্কান্দর আলম চৌধুরী ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পান।
এই ঘটনায় মীর কাসেমকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের সাত বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকে আপিলে।
অভিযোগ-১৪: নভেম্বর মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন নাজির আহমেদ চৌধুরী রোডে এ জে এম নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। একদিন গভীর রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন আলবদর সদস্য ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। তাঁরা নাসিরুদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যান এবং সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন চালান। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে আরও এক-দেড় শ লোকের সঙ্গে নাসিরুদ্দিনকেও উদ্ধার করেন স্থানীয় লোকজন। এই অভিযোগে মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড আপিলে বহাল থাকে।
অপর তিনটি অভিযোগ: ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনা ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে আপিলে তিনটি অভিযোগে (৪, ৬ ও ১২) খালাস পান তিনি। চতুর্থ অভিযোগ, আজিজ কলোনি থেকে সাইফুদ্দিন খানকে অপহরণ ও ডালিম হোটেল নিয়ে মারধর করা, ষষ্ঠ অভিযোগ হারুন-অর-রশিদকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করার। পরে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। ১২ নম্বর অভিযোগ অনুসারে, নভেম্বরের কোনো একদিন হাজারী লেনের বাসা থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে আটক করেন মীর কাসেমের নেতৃত্বাধীন আলবদর সদস্যরা। ওই সময় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হাজারী লেনের ২৫০ থেকে ৩০০ ঘরে আগুন দেওয়া হয়। পরে জাহাঙ্গীর আলমকে আলবদররা ছেড়ে দিলেও রঞ্জিত ও টুন্টুকে ডালিম হোটেলে নির্যাতন ও পরে হত্যা করা হয়।
মীর কাসেম আলী: রাষ্ট্রপক্ষেরনথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মীর কাসেম আলী জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩ বছর বয়সী এই মানবতাবিরোধী অপরাধীর পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। তবে বাবার চাকরির সূত্রে তিনি ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রামে থাকতেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি ছিলেন। ৭ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। মীর কাসেম ছিলেন ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি জামায়াতের শুরা সদস্য। জামায়াত ঘরানার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাও তিনি।