মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব এক হাসপাতাল

বাংলাদেশি জনবলে ও অর্থায়নে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে চিকিৎসাকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের মেডিকেল যুদ্ধের আইকনে পরিণত হয়।

বাংলাদেশ হাসপাতাল, ১৯৭১। ছবিটি স্বাধীনতা যুদ্ধ আর্মি মেডিকেল কোর গ্রন্থ থেকে নেওয়া।

মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা-ইতিহাস গবেষণার অংশ হিসেবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ভারতের আগরতলায় স্থাপিত বাংলাদেশ হাসপাতালটির ইতিবৃত্ত অনুসন্ধান করি। ঐতিহাসিক দলিল, প্রকাশিত স্মৃতিচারণামূলক বই এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই হাসপাতালের ইতিহাস আমরা বিস্তারিত উপস্থাপন করব আমাদের এ বিষয়ে প্রকাশিতব্য বইয়ে। এখানে সেই লেখার একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান উপস্থাপন করছি।

শ্রীমন্তপুরে গোয়ালঘরে হাসপাতাল পরিচালনা করতে থাকা ডা. আখতার পাকিস্তানি আক্রমণে বাধ্য হয়ে পিছু হটে সোনামুড়ায় চলে আসেন। এরপর ডা. নাজিম আর ডা. আখতার যৌথভাবে এ হাসপাতাল চালাতে থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের প্রতিটির হেডকোয়ার্টারের সঙ্গেই একটি করে মেডিকেল ইউনিট ছিল। জনবল ও যন্ত্রপাতির দিক থেকে সব সেক্টরের মেডিকেল স্থাপনা অবশ্য সমান ছিল না। নৌ কমান্ডোদের সেক্টর স্বাগতিক সেক্টরের মেডিকেল ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করে চলত। কেবল ২ নম্বর সেক্টরের মেডিকেল স্থাপনা ছিল সদর দপ্তর থেকে খানিকটা দূরে, অনেকটা স্বতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপনার মতো। ২ নম্বর সেক্টর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলার আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ঢাকা শহর ও ফরিদপুর জেলার পূর্বাংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল ভারতের আগরতলায়, প্রথমে মতিনগরে, পরে মেলাঘরে। এর নেতৃত্বে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধের পরিকল্পনা এবং পরিচালনা মূলত এই সেক্টর থেকেই করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আহতদের জটিল ও সমন্বিত চিকিৎসাগুলো দেওয়া হতো মূলত ভারতীয় কোনো হাসপাতালে, তবে স্বতন্ত্রভাবে সম্পূর্ণ বাংলাদেশি জনবলে ও অর্থায়নে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে পরিচিত এই চিকিৎসাকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের মেডিকেল যুদ্ধের আইকনে পরিণত হয়। বাংলাদেশ হাসপাতালের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে যে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম বিশেষভাবে জড়িত, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এম এ মোবিন, প্রয়াত ডা. আখতার আহমেদ, ডা. নাজিমুদ্দীন আহমেদ ও ডা. সিতারা বেগম।

২.

১৯৭১ সালে লেফটেন্যান্ট ডা. আখতার আহমেদ ছিলেন আর্মি মেডিকেল কোরের একজন তরুণ চিকিৎসক। সে সময় তাঁর পোস্টিং ছিল কুমিল্লায়; ৫৩ ব্রিগেডে ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে। ২৭ মার্চ সকালে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলে যে সফল বিদ্রোহ ঘটে, ডা. আখতারও তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিদ্রোহ শেষে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বিদ্রোহের পুরস্কার হিসেবে ডা. আখতারকে তিনি তৎক্ষণাৎ লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করেন। ক্যাপ্টেন আখতার মেজর খালেদের সঙ্গে পরামর্শ করে কুমিল্লা সীমান্তের কাছে আগরতলার শ্রীমন্তপুর এলাকায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেন। হাসপাতালের জন্য কোনো স্থাপনা পাওয়া না গেলে তিনি একটি গোয়ালঘর পরিষ্কার করে ইটের ওপর কাঠের তক্তা বসিয়ে বিছানা বানিয়ে হাসপাতালের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। তবে শ্রীমন্তপুর থেকে সরে গিয়ে পরে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ হাসপাতাল গড়ার অন্যতম আরেক কারিগর ডা. নাজিমুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে, যিনি স্বতন্ত্রভাবে চিকিৎসাসেবার কাজ শুরু করেছিলেন আগরতলার সোনামুড়া এলাকায়।

ভারতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ হাসপাতালের অবস্থান
ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে ডা. নাজিম কর্তব্যরত ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। এর আগে ডা. নাজিম রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। ২৭ মার্চ ময়মনসিংহে ইপিআরে আক্রমণ এবং পুলিশ লাইনস থেকে অস্ত্র লুটের ঘটনায় অংশ নেন ডা. নাজিম। ২৯ মার্চ মেজর সফিউল্লাহর অধীন ক্যাপ্টেন নাসিম (পরে সেনাপ্রধান) এবং আর্মি মেডিকেল কোরের লেফটেন্যান্ট ডা. মোকতার কামাল চৌধুরী ময়মনসিংহ মেডিকেলে আসেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করতে। তাঁদের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ডা. নাজিম পরবর্তী সময়ে আগরতলায় গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। তিনি সেখানে পৌঁছানোর পর সীমান্ত এলাকা বিবির বাজারে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। সেই আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে আগরতলার সোনামুড়ায় ডা. নাজিম একটি বাংলো ঘরে অস্থায়ী হাসপাতাল বানিয়ে চিকিৎসা দিতে থাকেন।

শ্রীমন্তপুরে গোয়ালঘরে হাসপাতাল পরিচালনা করতে থাকা ডা. আখতার পাকিস্তানি আক্রমণে বাধ্য হয়ে পিছু হটে সোনামুড়ায় চলে আসেন। এরপর ডা. নাজিম আর ডা. আখতার যৌথভাবে এ হাসপাতাল চালাতে থাকেন। একসময় স্থানীয় বন বিভাগের সঙ্গে দেনদরবার করে হাসপাতালটিকে তাদের একটি টিনের ঘরে স্থানান্তর করেন। ডা. আখতার ২ নম্বর সেক্টরের সেনা অফিসার থাকার কারণে পদাধিকারবলেই হয়ে যান হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার, তবে মূল কাজকর্ম চালাতেন ডা. নাজিম। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানিদের আক্রমণ বেড়ে গেলে একপর্যায়ে বাংলাদেশ হাসপাতাল সরিয়ে আরও খানিকটা ভেতরে সেক্টরের মূল কার্যালয়ের কাছে মেলাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে হাসপাতালের সাংগঠনিক শক্তি আরও মজবুত হয়। এ সময় এতে নার্সিংয়ে নিয়োজিত অন্যদের সঙ্গে এসে যোগ দেন কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাহিদা কামাল, স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহর পরিবার এবং অন্যরা। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী একপর্যায়ে এই হাসপাতাল পরিদর্শন করতে আসেন।

একাত্তরের মে মাসের দিকে এই মেলাঘর হাসপাতালে ইংল্যান্ড থেকে এসে যোগ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মোবিন।

তাঁরা এই হাসপাতালের পরিধি এবং কার্যক্রমের আরও ‍বিস্তৃতি ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ডা. মোবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ দুজনই তখন যুক্তরাজ্যে এফআরসিএস দ্বিতীয় পর্বে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। ডা. মোবিন জেনারেল ও কার্ডিয়াক সার্জারিতে এফআরসিএস করছিলেন স্কটল্যান্ডে এবং ডা. জাফরুল্লাহ সার্জারি ও ভাসকুলার সার্জারিতে লিডসের ইয়র্ক হাসপাতালে। পূর্বপরিচয়ের সূত্রে তাঁরা দুজন ছিলেন বন্ধু।

ডা. আখতার আহমেদ, ডা. নাজিমুদ্দীন আহমেদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. সিতারা বেগম

যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য ডা. জাফরুল্লাহর উদ্যোগে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে তৈরি হয়। সে সময় যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রায় ৪০০ বাংলাদেশি ডাক্তারকে প্রত্যেকে মাসে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বাঙালিরা হাইড পার্কে পাকিস্তানবিরোধী একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সে সমাবেশে ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মোবিন সাংবাদিকদের সামনে পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেন। এরপর তাঁরা দুজন ভারতে গিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁদের পাসপোর্ট না থাকায় ভিসা পাওয়া নিয়ে সংকট দেখা দেয়। এই দুজন তখন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রাজ্যহীন (স্টেটলেস) নাগরিকের সনদ বের করে তার ভিত্তিতে ভিসা নিয়ে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে করে ভারতের পথে রওনা দেন। তাঁরা দামাস্কাসে যাত্রাবিরতি করলে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা সিরিয়ার সরকারের কাছে ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মোবিনকে গ্রেপ্তারের জন্য অনুমতি চায়, কিন্তু বিমানের পাইলট তাতে বাদ সাধেন। তিনি জানান, উড়োজাহাজ রানওয়েতে, যা নিরপেক্ষ একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল, সেখানে সিরিয়া বা পাকিস্তান কোনো দেশের আইনই প্রযোজ্য হবে না। তিনি কোনো যাত্রীকে বন্দী হস্তান্তরের মতো হস্তান্তর করতে অপারগ। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলার পর দীর্ঘ নাটকীয়তা শেষে দামাস্কাস বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজটিকে ছাড়পত্র দেয়। দিল্লি ও কলকাতা হয়ে অবশেষে তাঁরা আগরতলা পৌঁছে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানেই তাঁদের ডা. আখতারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তখন মেলাঘরের বাংলাদেশ হাসপাতাল পরিচালনা করছিলেন।

ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মোবিন দুজনই দক্ষ সার্জন ছিলেন। ডা. মোবিন হাসপাতালের কাজে নেমে পড়েন। ডা. জাফরুল্লাহ আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়েন হাসপাতালটির সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশি ডাক্তার-নার্স দিয়ে সেটি পরিচালনা করার পরিকল্পনায়।

৩.

ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মোবিন দুজনই দক্ষ সার্জন ছিলেন। ডা. মোবিন হাসপাতালের কাজে নেমে পড়েন। ডা. জাফরুল্লাহ আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়েন হাসপাতালটির সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশি ডাক্তার-নার্স দিয়ে সেটি পরিচালনা করার পরিকল্পনায়। মেজর খালেদ মোশাররফ কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী সরকারের কাছে এই নতুন হাসপাতালের প্রস্তাব পেশ করে ৫ হাজার টাকা বরাদ্দের জন্য অনুরোধ করলে তারা ৫০ হাজার টাকা অনুমোদন দেয়। অনুদানের ১০ হাজার টাকার প্রথম চেক হস্তান্তর করেন তৎকালীন কেবিনেট সেক্রেটারি এইচ টি ইমাম। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ইউকে থেকে প্রাপ্ত অর্থও এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় খরচ করা হয়। প্রবাসী সরকারকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার জন্য বিএমএ ইউকেকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে জেনারেল ওসমানী পরবর্তীকালে চিঠি লেখেন। এরপর নতুন হাসপাতালের জন্য আগরতলার আরও ভেতরে বিশ্রামগঞ্জ এলাকায় হাবুল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজনের লিচুবাগানকে হাসপাতালের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। লিচুগাছ না কাটার শর্তে হাবুল বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিলে সেখানে বিভিন্ন বিভাগসহ একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত তিনজন প্রকৌশলী নূরুল হুদা, তাজুল ইসলাম ও মাহবুবুল হক হাসপাতালের কাজ তদারকি করতে আসেন। এ ছাড়া ক্র্যাক প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলমের বাবা প্রকৌশলী হাফিজুল আলম নিযুক্ত হন হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। অবশেষে ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ হাসপাতাল মেলাঘরের দারোগা বাগিচা থেকে বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়।

সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম। তিনি ছিলেন খালেদ মোশাররফের সহযোগী ক্যাপ্টেন হায়দারের ছোট বোন। ক্যাপ্টেন সিতারা মুক্তিযুদ্ধ ‍শুরু হওয়ার পর বেশ কয়েক মাস বাংলাদেশে অবরুদ্ধ ছিলেন। একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন হায়দার তাঁকে আগরতলায় চলে আসতে বলেন। ডা. আখতার তখন বাংলাদেশ হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট হলেও প্রায়ই নানা সাবসেক্টরে তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হতো। সে কারণে ডা. সিতারা এলে অক্টোবরে তাঁকে বাংলাদেশ হাসপাতালের কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডা. সিতারা পরবর্তীকালে বীর প্রতীক উপাধি পান।

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জন পর্যন্ত বিভিন্নভাবে ডা. আখতার, ডা. নাজিম, ডা সিতারা এবং পরামর্শক হিসেবে ডা. মোবিন বাংলাদেশ হাসপাতালে সক্রিয় ছিলেন। যুদ্ধের সময়টি ডা. জাফরুল্লাহ মূলত সক্রিয় ছিলেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে হাসপাতালের জন্য অর্থ, যন্ত্রপাতি, ত্রাণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন উপকরণ জোগাড় করার কাজে।

অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ হাসপাতালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তখন সেখানে ছয়জন ডাক্তার, চারজন মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবী নার্স কর্মরত ছিলেন। ২ নম্বর সেক্টরের অধীন সাবসেক্টরগুলোতে ফার্স্ট এইডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা থাকতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ আহত হলে তাঁরা তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে স্ট্রেচারে করে সাবসেক্টর মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে আসতেন। যাঁদের ছোট আঘাত, শরীরে গুলির স্প্লিন্টার ইত্যাদি থাকত, তাঁদের সাবসেন্টারেই রেখে দেওয়া হতো। যাঁদের আরও বড় রকমের আঘাত থাকত, তাঁদের বিশ্রামগঞ্জের মূল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। সেখানে স্থান সংকুলান হতো ১০০ জন রোগীর। তবে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কেউ কেউ ৪০০ বেডের কথাও উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর শত্রু এলাকায় ঢুকে হাসপাতাল ও ফার্মেসি প্রভৃতি আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ হাসপাতালের বহু যন্ত্রপাতি ও ওষুধ জোগাড় করে দিয়েছেন। চিকিৎসকেরাও স্থানীয় উপকরণ দিয়ে নানা উদ্ভাবনী উপায়ে হাসপাতালের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। তাঁরা মশারির চাদর কেটে ব্যান্ডেজ বানিয়েছেন; কামারের দোকান থেকে টমাস স্প্লিন্টার বানিয়ে পা না কেটে ভাঙা পায়ের চিকিৎসা করেছেন, আঙুল বড়শির মতো বাঁকা করে গুলি বের করে এনেছেন ফুসফুস থেকে। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যেকোনো মূল্যে জীবন বাঁচানোই ছিল তখন ডাক্তারদের মূল লক্ষ্য।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন ডা. মোবিন বাংলাদেশ হাসপাতালেই কাজ করছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ ছিলেন কুমিল্লায়। কুমিল্লায় জাফরুল্লাহ এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন কি না জেনারেল ওসমানী প্রবাসী সরকারের কাছ থেকে সে নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। নির্দেশ না আসার একপর্যায়ে ওসমানী সিলেটে তাঁর মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬ তারিখ তাঁরা একটা ছোট এমএইট প্লেনে সিলেটে রওনা দেন। সেই প্লেনে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্নেল এ রব, তাঁর এডিসি বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখ কামাল, ডা. জাফরুল্লাহ, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্তা এবং বাংলাদেশের এক রিপোর্টার। কিন্তু যাওয়ার পথে হঠাৎ একটি অজানা স্থান থেকে তাঁদের উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। এতে প্লেনের তেলের ট্যাংকারও ফুটো হয়ে যায়। কারা গুলি ছুড়েছিল, সেটি এখনো রহস্য রয়ে গেছে। কারণ, তাঁদের ধারণা ছিল, সিলেটের ওই অঞ্চলটি মুক্ত। গুলিতে আহত হন সেনা উপপ্রধান কর্নেল রব এবং শেখ কামাল। শেখ কামালের আঘাত কম হলেও কর্নেল রব মারাত্মক আহত হন। ডা. জাফরুল্লাহ প্লেনের ভেতরেই রবকে শুইয়ে মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং ও কার্ডিয়াক মাসাজ দেন।

আমাদের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডা. জাফরুল্লাহ সেই নাটকীয় মুহূর্তের বিবরণ দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অব আর্মি স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকবও তাঁর বইয়ে ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। পাইলটের বিচক্ষণতা, জেনারেল ওসমানীর সাহস সব মিলিয়ে প্লেনটি সে দিন নিরাপদে ল্যান্ড করে। সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক ও নৃতত্ত্ববিদ

খায়রুল ইসলাম: ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক