১৯৬৯ সালের গণ–আন্দোলনের সময় পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক ব্রিগেডের নেতৃত্ব পান বগুড়ার তরুণ তৌফিকুল আলম। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তৌফিকুল সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ট্রাকে করে ঘুরে মানুষকে জাগানোর গণসংগীত গাইতেন। উদ্বুদ্ধ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের লেট দেয়ার বি লাইট অবলম্বনে গীতিনাট্য রচনা করে তা মঞ্চে পরিবেশন করেন। মুক্তিকামী মানুষ উজ্জীবিত হয় তাঁর সেই অনন্য কৌশলে।
১৯৭১ সালে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ঘর ছেড়ে তৌফিকুল আলম ভারতে প্রশিক্ষণ শিবিরে হাজির হন। আগরতলা প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছালে ইনচার্জ তাঁকে রণাঙ্গনে ফিরে মুক্তির গানের মাধ্যমে মানুষকে জাগানোর পরামর্শ দেন। এরপর দেশে ফিরে দেশের আনাচকানাচে তৌফিকুল গেয়ে বেড়ান মুক্তির গান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে তৌফিকুল আলম আঞ্চলিক গানের মাধ্যমে গণমানুষকে জাগাতে গড়ে তোলেন বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার। আশির দশকে বিটিভির বিশেষ আয়োজন মানেই তৌফিকুল আলমের বগুড়া ইয়ুথ কয়্যারের পরিবেশনা। ‘ওই কালো ছুড়িডা হামাক পাগলা করিচে, ওই কালো ছুড়িডা হামাক দেওয়ানা করিচে’ কালো বর্ণের মেয়ের দুঃখ ভোলানো এই গান আশির দশকেও ছিল তুমুল জনপ্রিয়। জনপ্রিয় এ গানের গীতিকারও তৌফিকুল। বগুড়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছোট-বড় সবার কাছে তিনি কেবলই ‘টিপু ভাই’ নামে পরিচিত।
তৌফিকুলের গানে উঠে এসেছে গণমানুষের কথা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে, বর্ণ–বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে তাঁর গান শাণিত করেছে মানুষকে। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত তৌফিকুল আলম বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও একবিন্দু ভাটা পড়েনি তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে। এখনো সমানতালে আঞ্চলিক গান, নাচের তালিম দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মকে।
তৌফিকুল আলম বলেন, ‘ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। মুক্তিযুদ্ধের পরও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে গাইলাম গণসংগীত। একসময় আঞ্চলিক গানের মাধ্যমে গ্রামের যুবসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার চিন্তা এল মাথায়। এরপর গড়ে তুললাম বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার।’
আর দেশপ্রেমজাগানিয়া জনপ্রিয় আঞ্চলিক গানগুলো রচনার প্রসঙ্গ তুললে তৌফিকুল আলম জানান, সত্তরের দশকে বগুড়ার শেরপুরের বিখ্যাত দইয়ের দাম পাঁচ সিকা থেকে এক লাফে পাঁচ টাকায় ওঠে। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে গান লেখেন, ‘গোবরা খ্যায়া যা শেরপুরের দই, পাঁচ সিকা আচল এখন পাঁচ টেকায় লই।’ এ গান দিয়েই ইয়ুথ কয়্যারের শুরু।
১৯৭৮ সালে বগুড়া মহিলা ক্লাবে গানের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে এসেছিলেন তৎকালীন তথ্যসচিব। ইয়ুথ কয়্যার পরিবেশন করে ‘হামরা বগুড়ার ছল, পুঁটি মাছ মারবার য্যায়া মারে আনি বোল, ‘ক্যারে বড় বউ তুই ঘুমত থ্যাকে উঠিস না ক্যারে’সহ বেশ কয়েকটি গান। কয়েক মাস পরই ইয়ুথ কয়্যারের ডাক পড়ে বিটিভিতে।
তৌফিকুল আলম বলেন, ইয়ুথ কয়্যারের গান তখন মানুষের মুখে মুখে। আশির দশকে বের হয় প্রথম অডিও অ্যালবাম গ্যাঞ্জাম। এ অ্যালবামে ছিল, ‘গ্যাঞ্জাম লাগিসে খালি গ্যাঞ্জাম’, ‘হামি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতাত এডা কেনডিডেট পাঠামু, নাম শুকিমন’, ‘অস্ত্রডা জমা দিচি টেরলিং ডা না, তুই ক্যামা মিছামিছি ভয় করিস মা’ ইত্যাদি।
ইয়ুথ কয়্যারের প্রতিটি গানে রয়েছে সমাজকে জাগানোর বার্তা। বিভিন্ন টেলিভিশনে সংগঠনটি এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক অনুষ্ঠান করেছে। প্রায় ৫০ জেলায় অনুষ্ঠান করেছেন ইয়ুথ কয়্যারের শিল্পীরা। তৌফিকুল আলমের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক শিল্পীর নিয়মিত মহড়া চলে শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে ইয়ুথ কয়্যারের কার্যালয়ে। আশপাশ দিয়ে গেলে কানে ভেসে আসে সুর। পরিচিত সুরে কথা জুড়ে দিয়ে মনে বাজে স্মৃতিজাগানিয়া গান।