মেঘনায় লঞ্চডুবি, ১২ লাশ উদ্ধার

লঞ্চডুবির পর ছেলে আবিরকে ফিরে পেয়েছেন মা নাজমা বেগম৷ তবে ছেলেকে এমনভাবে ফিরে পেতে চাননি৷ লঞ্চডুবিতে আদরের আবির যে মাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদূরে৷ গতকাল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো
লঞ্চডুবির পর ছেলে আবিরকে ফিরে পেয়েছেন মা নাজমা বেগম৷ তবে ছেলেকে এমনভাবে ফিরে পেতে চাননি৷ লঞ্চডুবিতে আদরের আবির যে মাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদূরে৷ গতকাল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় মেঘনা নদীতে গতকাল বৃহস্পতিবার তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি লঞ্চ ডুবে গেছে৷ গতকাল রাত সাড়ে ১২টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷ নিখোঁজ আছেন অন্তত ২৪০ জন যাত্রী৷
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এমভি মিরাজ-৪ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চটি বেলা দুইটার দিকে ঢাকার সদরঘাট থেকে শরীয়তপুরের সুরেশ্বরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়৷ পথে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে গজারিয়ার ইমামপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর কালিপুরা এলাকায় পেঁৗছালে লঞ্চটি ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।
দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজন উদ্ধারকাজ শুরু করেন। পরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়৷ বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ডুবুরি দল ৫০ মিটার পানির নিচে লঞ্চটি শনাক্ত করে৷
মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান ১২টি লাশ উদ্ধারের কথা নিশ্চিত করেন৷ গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল করিম প্রথম আলোকে জানান, পরিচয় নিশ্চিত হয়ে নড়িয়া উপজেলার রাহাপাড়া গ্রামের িসতারা বেগম (৫০) ও সুরেশ্বর গ্রামের জলিল মিয়ার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, দুজন পুরুষ, চারজন নারী ও ছয়টি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷ ৫০ জনের মতো যাত্রীকে জীিবত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে৷
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে যান৷ তিনি জানান, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার ও সরকার থেকে আরও ৫০ হাজারসহ মোট ৭০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে৷
এদিকে, নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে শত শত মানুষ মেঘনার তীরে ভিড় করছেন৷ স্বজনদের না পেয়ে আহাজারি করছেন অনেকেই৷
বেঁচে যাওয়া যাত্রী মো. আলী জানান, তিনি ক্যানসার আক্রান্ত ১০ বছরের ছেলে আরিফকে নিয়ে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন৷ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আকাশ কালো করে প্রচণ্ড বেগে ঝড় ওঠে৷ এতে লঞ্চটি বঁা দিকে কাত হয়ে উল্টে যায়। একটু দূরে থাকা একটি ট্রলার গিয়ে তঁাকেসহ আট যাত্রীকে উদ্ধার করে। কিন্তু ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি৷
স্বামী ও ছেলেকে হারিয়ে আহাজারি করছিলেন সাঁতরে তীরে ওঠা যাত্রী নাজমা বেগম৷ কাঁদতে কাঁদতে তিনি জানান, স্বামী জালাল শিকদার (৪৫) ও দেড় বছরের ছেলে আবিরের লাশ পেয়েছেন তিনি৷ তাঁরা একই পরিবারের ছয়জন লঞ্চে ছিলেন। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার সময় তিনিসহ চারজন নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।
নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে মেঘনার তীরে রাত অবধি শত শত মানুষের ভিড় ছিল৷ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৫ জন ডুবুরি উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান মো. শাসছুদ্দোহা খন্দকার প্রথম আলোকে জানান, ৫০ জনের মতো যাত্রী নানাভাবে বেঁচে গেছেন। বািকরা নিখোঁজ আছেন। উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় রাতের মধ্যেই এটিকে টেনে তুলতে পারবে৷
গত বছরও গজারিয়ার চরঝাপটা এলাকায় মেঘনা নদীতে আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে এমভি শরীয়তপুর-১ নামের একটি লঞ্চ ডুবে যায়৷ সেই দুর্ঘটনায় দেড় শতাধিক যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সেই দুর্ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই গতকালের দুর্ঘটনা ঘটে৷
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে লঞ্চের অনেক যাত্রীর স্বজন শরীয়তপুরের সুরেশ্বর ঘাটে ভিড় করেন৷ শরীয়তপুর সদর উপজেলার আবদুর রাজ্জাক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আসাদুজ্জামান মিন্টু (২৮) ওই লঞ্চে ঢাকা থেকে ফিরছিলেন৷ তাঁর ভাই আজাহার খান বলেন, ‘ভাই চিকিৎসা শেষে লঞ্চযোগে বাড়ি ফিরছিলেন৷ তাঁর সঙ্গে প্রতিবেশী মো. রাসেল ছিল। রাসেল সাঁতার কেটে তীরে উঠতে পারলেও ভাইয়ের খোঁজ পাচ্ছি না৷’ লঞ্চটির শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা, নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর, সাধুর বাজার ও ওয়াপদা ঘাটে যাত্রী নামানোর কথা ছিল। অধিকাংশ যাত্রীই শরীয়তপুরের নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। সুরেশ্বর লঞ্চঘাটের ইজারাদার আদিল মুন্সী বলেন, অনেকেই বৃহস্পতিবার কাজ শেষ করে লঞ্চযোগে বাড়ি ফিরে আসেন৷ এ ছাড়া, সুরেশ্বর ঘাটের একটি দরবার শরিফে ওরস চলছে। এ কারণে লঞ্চে যাত্রী স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেিশ ছিলেন৷
নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনেরা বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সুরেশ্বর ঘাট থেকে দুটি লঞ্চ ও দুটি ট্রলারযোগে দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হন৷ তার পরও ঘাটে শত শত উদ্বিগ্ন মানুষের িভড় ছিল৷ শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রামচন্দ্র দাস বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া লাশগুলো পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ট্রলার ও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে।