মেটার প্রামাণ্যচিত্রে জেরিনের গল্প

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ব্যতিক্রমী ও সফল উদ্যোক্তাদের গল্প প্রায়ই তুলে ধরে। সেখানে প্রথমবারের মতো স্থান পেলেন জেরিন।

নিজের তৈরি গয়নার ফটোশুটে মডেলদের সঙ্গে জেরিন তাসনিম খানের সেলফি
ছবি: সংগৃহীত

ছয় গজের গল্প। ‘সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি’ নামের ফেসবুক পেজটির বাংলা ভাষান্তর করলে অর্থ এমনই দাঁড়ায়। আর আঁচ করা যায় যে পেজটি শাড়ি নিয়ে। শুরুটা শাড়ি বিক্রির মধ্য দিয়েই হয়েছিল। তবে এখন অনলাইন উদ্যোগ ‘সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি’তে চাহিদা বেশি ঐতিহ্যবাহী নকশায় তৈরি আধুনিক গয়নার। শাড়ি ও গয়না বিক্রির এই পেজের লাইক ১ লাখের বেশি।

এই ফেসবুক পেজ ও সেটার ওপর নির্ভর করে অনলাইন ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তা জেরিন তাসনিম খান। তাঁর উদ্যোগকে প্রচারণার জন্য বেছে নিয়েছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ব্যতিক্রমী ও সফল উদ্যোক্তাদের গল্প মেটা প্রায়ই তুলে ধরে প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। তাদের এই সিরিজটির নাম ‘ফরোয়ার্ড টুগেদার’ (একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া)। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রচার করা প্রামাণ্যচিত্রের চতুর্থ পর্বে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তিন নারী উদ্যোক্তার সফলতার কাহিনি তুলে ধরা হয়, যার মধ্যে একজন ছিলেন জেরিন তাসনিম খান। এই তিনজনকে মেটা ‘কমিউনিটি লিডার’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

এরপর আমি ফেসবুকে পেজ খুললাম। শাড়ির দৈর্ঘ্য যেহেতু ছয় গজ, তাই উদ্যোগের নাম দিলাম সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি। বন্ধুদের শাড়ি পরিয়ে তাঁদের ছবি দিতাম ফেসবুক। এরপর ভালো সাড়া পেতে শুরু করলাম
জেরিন তাসনিম খান

জেরিন তাসনিম খান বেশি পরিচিত লরা খান নামে। এই তরুণী স্থপতি, ডিজাইনার এবং উদ্যোক্তা। মেটার প্রচারণায় বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো তাঁর উদ্যোগটিই তুলে ধরা হয়েছে।

ভিডিওর শুরুতেই মেটার এপিএসি (এশিয়া-প্যাসিফিক) কমিউনিটি পার্টনারশিপসের পরিচালক গ্রেস ক্ল্যাপহ্যাম পরিচয় করিয়ে দেন জেরিন তাসনিম খানকে। গ্রেস বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের অর্ধেকই যেহেতু নারী, তাই তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইনে নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী নকশার গয়না তৈরি করে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে জেরিন নিজেকে প্রমাণ করেছেন।

ফরোয়ার্ড টুগেদারের চতুর্থ পর্বে জেরিনের সঙ্গে ফিলিপাইনের আলিয়া মাদারের স্বত্বাধিকারী নাদিন অ্যাঞ্জেলিকা গাদিয়া-ক্যাসিনো এবং স্পেনের সোলো ফিমেল ট্রাভেলার্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার পেজেসের কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

ভিডিওতে জেরিন তাসনিম খান সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি গড়ে ওঠার গল্প বলে যান।

শুরুটা ২০১৪ সালে। তখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রী জেরিন। কয়েক বান্ধবীকে নিয়ে গেলেন নিজেদের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। সেখানে প্রচুর তাঁতি শাড়ি বোনেন। বন্ধুরা চাইলেন তাঁতিবাড়ি যেতে। জেরিন নিয়ে গেলেন। প্রত্যেকেই কয়েকটা করে সুতির শাড়ি কিনলেন সরাসরি তাঁতির কাছ থেকেই। জেরিনকে বন্ধুরা বললেন, এখানে কম দামে এত সুন্দর শাড়ি। এগুলো ঢাকায় বিক্রির উদ্যোগ তো নেওয়া যায়।

‘এরপর আমি ফেসবুকে পেজ খুললাম। শাড়ির দৈর্ঘ্য যেহেতু ছয় গজ, তাই উদ্যোগের নাম দিলাম সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি। বন্ধুদের শাড়ি পরিয়ে তাঁদের ছবি দিতাম ফেসবুক। এরপর ভালো সাড়া পেতে শুরু করলাম।’ গত বুধবার প্রথম আলোকে এভাবেই উদ্যোগের শুরুর গল্প শোনালেন জেরিন তাসনিম খান।

শুধু শাড়ি পরিয়ে ছবি দিলেই তো হয় না, সঙ্গে লাগে অনুষঙ্গ। জেরিনের নিজের সংগ্রহে ছিল অনেক পুরোনো আমলের গয়না। ছবি তোলার সময় শাড়ির সঙ্গে পরিয়ে দিতেন সেগুলো। জেরিন বলেন, ‘কিছুদিন পর দেখলাম, পেজের গ্রাহকেরা গয়নার ব্যাপারে জানতে চাইছেন, কিনতে চাইছেন। শাড়ির চেয়েও গয়না নিয়ে আগ্রহ বেশি। তখন গয়না তৈরি শুরু করলাম।’

সিক্স ইয়ার্ড স্টোরিতে গয়নার সেই চাহিদা তো কমেইনি, বরং আট বছরে তা বেড়েছে। জেরিনের এই উদ্যোগ পুরোই অনলাইনভিত্তিক। তাঁর কোনো দোকান নেই। শাড়ি ও গয়নার সব নকশা নিজে করেন। এখন তাঁর সঙ্গে কাজ করেন আটজন দক্ষ কারিগর। তামা, রুপা ও সোনার গয়না পাওয়া যায় সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরিতে। এখন হীরার গয়নাও যোগ হয়েছে পণ্যতালিকায়।

জেরিন দেখলেন ‘লকডাউনে’র কারণে বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার মানুষও নেই অনেক বাসায়। তখন সিক্স ওয়ার্ড স্টোরি থেকে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো। জেরিন বলেন, ‘এতে অনেকের উপকার হলো। আর আমাদের ডেলিভারিম্যানরাও (পণ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালনকারী) কাজ পেল। চার মাসের মতো এ সেবা দিয়েছি আমরা।’

মেটার নজরে পড়লেন কীভাবে? জেরিন বলেন, ‘তা তো জানি না। মেটা থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা জানায়, নারী দিবসে বাছাই করা ভালো নারী উদ্যোক্তাদের তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশ থেকে আপনাকে নির্বাচন করা হয়েছে।’

২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশে যখন করোনা মহামারির কঠিন সময়, তখন ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন জেরিন তাসনিম খান। শাড়ি ও গয়নার কোনো ফরমাশ (অর্ডার) নেই। এদিকে পণ্য সরবরাহকারীরাও ঘরে বসা। জেরিন দেখলেন ‘লকডাউনে’র কারণে বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার মানুষও নেই অনেক বাসায়। তখন সিক্স ওয়ার্ড স্টোরি থেকে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো। জেরিন বলেন, ‘এতে অনেকের উপকার হলো। আর আমাদের ডেলিভারিম্যানরাও (পণ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালনকারী) কাজ পেল। চার মাসের মতো এ সেবা দিয়েছি আমরা।’

জেরিনের মতে, অনলাইন উদ্যোগে সফল হতে হলে সব সময় নজরে থাকতে হয়। মানে পেজে নতুন পণ্যের হালনাগাদ দিতে হয়। না হলে মানুষ ভুলে যেতে পারে। শুধু অনলাইনেই কি থাকবেন, জানতে চাইলে জেরিন বলেন, ‘অফলাইন ব্যবসায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই।’