মেয়েরা এগিয়েছেন, কিন্তু সমাজ?

কর্মজীবি নারী বলতেই স্কুল বা কলেজের অধ্যাপনা, নয়তো টেলিফোন অপারেটরের কাজ—এই গণ্ডি ছেড়ে বাঙালি নারী বেরিয়ে এসেছেন বেশ অনেক দিন। তবু পোশাকশ্রমিক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার নারীরা বলছেন, এখনো পর্যন্ত সন্তান ও সংসারের দেখভালের দায় পুরোটাই তাঁদের করতে হয়। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারছে না পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা খান প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু তাই বলে বাঙালি নারীদের প্রথাগত যে ভূমিকা, সেটি তাঁকে পালন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সমর্থন পান না। রাষ্ট্র নীতিগতভাবে অনেক দায়িত্বের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু এখনো কর্মজীবি নারী যখন কাজে আসবেন, তাঁর সন্তান কোথায় থাকবে, এর কোনো ব্যবস্থা সমাজে বা রাষ্ট্রে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে পুরুষেরা এখনো ঘরকন্নার দায়িত্ব নেন না। নারীদের দায়িত্ব পালন করতেই হয়, কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে (২০১০) দেখা গেছে, ২০০২-০৩ সালে শ্রমবাজারে যুক্ত ছিলেন ৯০ লাখ ৪০ হাজার, ২০০৫-০৬ সালে এ সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৩ লাখ এবং ২০১০ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৬২ লাখে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক রুশিদান ইসলাম রহমান তাঁর ‘লেবার মার্কেট ইন বাংলাদেশ চেঞ্জেস, ইনইকুইটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ গ্রন্থে বলেছেন, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষদের চেয়েও বেশি।
চিকিত্সক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক, শুল্কবিভাগের কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী নারীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তাঁরা বলছেন, নারীরা চাকরি করছেন, এ নিয়ে তাঁদের স্বামী-পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। কিন্তু এটুকু অর্জন করতে গিয়ে তাঁরা আসলে দ্বিগুণ বোঝা টানছেন। তাঁরা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে ‘শতভাগ যোগ্য’ প্রমাণ করতে গিয়ে একের পর এক দায়িত্ব কাঁধে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র তাঁদের যথেষ্ট সমর্থন দিচ্ছে না।
যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া, তৈরি পোশাক খাতে ও গ্রামাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারীদের অংশগ্রহণের কারণে গৃহকর্মী সংকট, গৃহকর্মীদের কাছে সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে নিরাপদ বোধ না করা ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি নারীরা। কিন্তু একজন নারী কর্মস্থলে গেলে সন্তান কোথায় থাকবে—তার ব্যবস্থা রাষ্ট্র করছে না। সংসার পরিচালনার দায় নারী ও পুরুষ সমানভাবে নিচ্ছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়াজ আহমেদ খান প্রথম আলো ডটকমকে বলেছেন, গত দুই দশকে ধীরে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কর্মস্থলে নারীদের অনেকটা সমীহ করে চলার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। চাকরিদাতারা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন যোগ্যতা-দক্ষতায় নারীরা কোনো অংশেই কম নন। কিন্তু তাঁরা এখনো মনে করেন একজন নারীকে চাকরি দেওয়ার অর্থ কিছু বাড়তি ‘মাথাব্যথা’, ‘উটকো’ ঝামেলা নেওয়া। এখনো যদি সমাজ ও রাষ্ট্র নারীদের সমর্থনে যথেষ্ট উপযোগী উদ্যোগ নিতে না পারে, তাহলে সমাজের এগিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হতে বাধ্য।
অংশগ্রহণ বেড়েছে অনেক কষ্টের বিনিময়ে: শুল্ক কর্মকর্তা রুকবা ইফফাত। ঢাকার মোহাম্মদপুরে কর্মরত ও এক সন্তানের মা। প্রথম আলো ডটকমকে তিনি বলেছেন, শুধু সন্তানকে দেখে রাখার কেউ নেই বলে তিনি তাকে ময়মনসিংহে তাঁর মা-বাবার কাছে রেখে এসেছেন। প্রতি সপ্তাহে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কাজের চাপ থাকলে দুই সপ্তাহে একবার। তিনি ঢাকায় বসে সন্তানের জন্য কাঁদেন, সন্তানও তাঁর জন্য কাঁদে। ছুটি-ছাটায় সন্তানকে নিয়ে আসেন, দুই দিনের বেশি কাছে রাখতে পারেন না।
তাই বলে বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীর সন্তানেরা যে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘ম্যাটারনাল ফ্যাক্টরস অ্যাফেকটিং চাইল্ড কেয়ার’ শীর্ষক গবেষণায় প্রতিমা পাল মজুমদার বলেছেন, সত্তর ও আশির দশকে করা কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী মায়ের শিশুরা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না (রফিকুল এইচ চৌধুরী, ১৯৮২), কর্মজীবী মায়ের শিশুরা অপুষ্টি সমস্যায় বেশি ভোগে (ব্যারি এম পপকিন), কর্মজীবী মায়ের শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় (বেঞ্জামিন এস ব্লুম, প্যাটেল, ফ্রেইবার্গ)। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে করা গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়ির বাইরে যে উচ্চশিক্ষিত মায়েরা কাজ করছেন, তাঁরা শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও উন্নত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকেন এবং সন্তানদের যে সময়টুকু দেন, সেটি মানসম্পন্ন। তাঁদের সন্তানেরা অনেক বেশি স্বনির্ভর এবং তারা মায়ের পেশা নিয়ে গর্ববোধ করে।
কিন্তু এই অর্জনটুকু করতে গিয়ে নারীদের সব সময় সমঝোতা করে চলতে হচ্ছে। স্থপতি মেহেরুন ফারজানা বলেছেন, সন্তানের জন্য অফিসের বড়কর্তার অনুমতি নিয়ে তিনি আধা ঘণ্টা পর আসতেন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের পর কাজ করলেও সহকর্মীরা ওই আধা ঘণ্টার জন্য তাঁর সমালোচনা করেন। চিকিত্সক ইশরাত জাহান বলেছেন, তিনি ও তাঁর স্বামী একই ব্যাচের, কিন্তু যখন উচ্চশিক্ষার সুযোগ আসে দুজনের জন্য, তিনি স্বামীকে সুযোগটা ছেড়ে দিয়েছেন। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে কর্মরত ছিলেন এমন একজন শিক্ষক শামসাদ জাহান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পরও তিনি সংসার ও সন্তানের জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যে প্রতিষ্ঠানে তিনি পড়াতেন, সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছিল মাত্র দুই মাস। তিনি ব্যথিত, তাঁর মা-বাবাও সমানভাবে কষ্ট পান। মেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, এমনটা আশা করেছিলেন তাঁরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের ‘উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী মহিলাদের পারিবারিক জীবন’ (২০০৮-০৯) নামের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের চাকরি করার কারণে প্রায় ৭২ শতাংশ পরিবারের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, আগের চেয়ে ভালো হয়েছে ২৬ শতাংশেরও বেশি পরিবারের। কিন্তু ৮০ শতাংশ নারীই বলেছেন, এ জন্য তাঁরা কোনো অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পান না, দাম্পত্য জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হন ৭৬ শতাংশেরও বেশি নারী। শতকরা ৫৪ জনেরও বেশি নারী মনে করেন, তাঁদের সন্তানেরা যথেষ্ট নিরাপদ নয়।
সমাজের উঁচুতলার নারীদের মতো একই সমস্যায় ভোগেন তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার শ্রমিকেরাও। সাজেদা খাতুন নামের এক শ্রমিক জানান, ১৮ মাসের শিশুকে ফেনীতে ফেলে তিনি যখন ঢাকায় কাজ করতে আসেন, তখন মন টিকত না তাঁর। তাঁর ভাষায়, ‘অ্যাবসেনের পর অ্যাবসেন করতাম, বেতন কাটা যাইত। লাইন চিপ বকা দিত।’ তাঁর আরেক বোন আয়েশা পোশাক কারখানার বেশি বেতনের চাকরি ছেড়ে ছুটা বুয়ার কাজ করেন সন্তানকে কিছুটা সময়ের জন্য শাশুড়ির কাছে রেখে।
সমাজ গবেষকেরা বলছেন, অপর্যাপ্ত হলেও নারীরা যেন পেশাগত জীবনে এগোতে পারেন, সে জন্য সরকার বেশ কিছু নীতি নিয়েছে। শিশুরা যেন মায়ের বুকের দুধ ছয় মাস পর্যন্ত পায়, সে জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা হয়েছে।
কী চান নারীরা: বাইরের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সংসার সামলানো অনেক ঝক্কির। এখনো সাবেকি কায়দায় কাপড় কাচা হয় বেশির ভাগ বাড়িতে। এখনো বাজার থেকে কাঁচা সবজি, মাছ কিনে এনে কেটে-কুটে রান্না চড়াতে হয়।
এসব কাজ করার পরও সন্তানকে একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে কাজ করবেন, এটুকু নিশ্চয়তা পেলেও তাঁরা স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে পারেন—এমনই বলছেন কর্মজীবী নারীরা। তা ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি দায়-দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেন, তাহলে তাঁদের সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়।
এ সবদিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য সাতটি ও মধ্যবিত্তদের জন্য তিনটি দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু আছে। এর বাইরে ১৪টি জেলা শহরে ১৪টি কেন্দ্র আছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মোট ২৪টি কেন্দ্রে সব মিলিয়ে এক হাজার ২০০ শিশু রাখা যায়। এ তথ্যটি বলে দেয় কর্মজীবী মায়েরা আসলে কেমন আছেন।