
একুশ চলে গেলেও মলিন হয়ে যায়নি মেলা। পায়ে পায়ে বহু লেখক-পাঠক-দর্শনার্থী-সংবাদ ও নিরাপত্তাকর্মী রঙিন করে রেখেছেন মেলাকে। গতকাল বিকেল থেকেই তরুণ-তরুণীদের আনাগোনায় মেলায় লেগে ছিল বসন্তের রং। মাথায় ফুলের ব্যান্ড পরা তরুণীদের দিকে তাকালে অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছিল।
গতকাল সোমবার মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে দেখা মেলে সুরভি নামের এক গৃহবধূর। এক হাতে বইয়ের ব্যাগ, অন্য হাতে ধরা শিশুসন্তানের হাত। কী বই কিনলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রান্না করতে ভালো লাগে বলে অনেকগুলো রান্নার বই কিনেছি। বাবুর জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন শুধু ওকে পড়াই। কদিন বাদেই স্কুলে যাবে ও।’
বিক্রি ও লোকসমাগম বলছে, মেলা এখনো ধরে রেখেছে বসন্ত। ব্যস্ত প্রকাশকদের প্রতিদিনই একটি-দুটি করে নতুন বই আসছে। সময় প্রকাশনের স্টলে গিয়ে দেখা গেল ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মতো স্তূপ করে রাখা কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মা বইটি। স্তূপের পাশে বসে এক তরুণ লেখক সেটি পড়ছেন। এই প্রকাশনী থেকে এ বছর বের হওয়া মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস স’তে সেন্টু ও আনিসুল হকের লিফটে আটকে পড়া যুবক-যুবতীরা বেশি বিক্রি হচ্ছে। অবসর থেকে পাঠকেরা বেশি কিনছেন হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস কসবি। তাম্রলিপির স্টলে গিয়ে দেখা যায় গুলতেকিন খানকে। আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম বইতে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন তিনি।
বিকেলে রোদ পড়ার পর স্কুলের পোশাকে নজরুল মঞ্চে তুলে আনা হয় ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুলের একঝাঁক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুকে। তাদের জন্য ছয়টি নতুন ব্রেইল বই নিয়ে এসেছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা। সেগুলোর মোড়ক উন্মোচনে এসেছিলেন সংস্কৃতিসচিব আক্তারী মমতাজ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, পরিচালক সাহিদা খাতুন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, এয়ারটেলের সিএসও রুবাবা দৌলা, স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার প্রধান নাজিয়া জাবীন। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য মেলায় ৪০ মিনিটের একটি পরিবেশনার সুযোগ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন শামসুজ্জামান খান। বড় প্রকাশনীগুলোকে বছরে অন্তত একটি বইয়ের ব্রেইল সংস্করণ ও সিডি প্রকাশের আহ্বান জানান নাজিয়া জাবীন। আক্তারী মমতাজ আশা করেন, ব্রেইলের মাধ্যমে পড়ালেখা শিখে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই শিশুরাও একদিন সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চা করবে। নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন করা হয় সৈয়দ আলী ইমামের কবিতার বই অকাল বসন্ত-এর। বইটি প্রকাশ করেছে স্টুডেন্ট ওয়েজ। বড় ভাইয়ের এই বইটির মোড়ক উন্মোচনে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আলী ইমাম রসিকতার ছলে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে আর কিছুতে না পারি বয়সে হারিয়ে দিয়েছি। এখন আমার তিরাশি।’
মেলার বাংলা একাডেমি অংশের যুবজাগরণের স্টলে দেখা যায় লম্বা সারি। জানতে চাইলে সারির ভেতর থেকে একজন বলেন, ‘এখনো শোনেননি! বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও শেখ হাসিনার মুজিব আমার পিতা মাত্র ১০০ টাকা করে দিচ্ছে। তবে একজনকে একটাই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাত জানালেন, বইটা ভালো লেগেছে বলে বন্ধুকে উপহার দেবেন তিনি।
গতকাল মেলায় দুটি নতুন বই এনেছে ঐতিহ্য। একটি কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের উপন্যাস আহ্নিকগতি ও আশির আহমেদের জাপান কাহিনি দ্বিতীয় খণ্ড; অন্বেষা এনেছে বুলবুল চৌধুরীর গল্পসমগ্র, সাউন্ড বাংলা এনেছে মো. সাদেকুর রহমানের স্বপ্ন কাব্য, চন্দ্রছাপ এনেছে অমল কুমার বর্মণের জলে ভাসি লখিন্দরের মতো, সময় এনেছে দন্ত্যস রওশনের একটি হলুদ নিমপাতা।
প্রথমার স্টলের সামনে ভিড় ঠেলে গিয়ে কথা বলতে হলো মনিরুদ্দিন শামীমের সঙ্গে। দুটো ব্যাগ বোঝাই করে প্রথমা থেকে বই কিনেছেন তিনি। বললেন, ‘বাচ্চা ফোন করে বইগুলো নিতে বলল।’ দেখা হলো সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গেও। বিএনপি: সময় অসময় বইটি খুঁজছিলেন তিনি। জানালেন, এখনো ইতিহাসভিত্তিক ও প্রবন্ধের বই পড়তে ভালোবাসেন তিনি। গতকাল প্রথমা প্রকাশন মেলায় এনেছে গণিতের বই সৃজনশীল গণিত। গণিত নিয়ে যাদের দুশ্চিন্তা ছিল, তা সামান্য হলেও কাটাবে বইটি। মেলার প্রথমার বিক্রয় প্রধান মো. ইউসুফ জানান, আনিসুল হকের জেনারেল ও নারীরা, আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন বইগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া লোকের নজর কাড়ছে রফিকুন নবীর দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা বইটি। অনেক গুণীজনের জীবনকথা রয়েছে বইটিতে।
গতকাল অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২২তম দিনে নতুন বই এসেছে ৬৪টি। বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ছিল আলোচনা শাহ আবদুল করিম জন্মশতবার্ষিকী। এতে প্রবন্ধ পড়েন অধ্যাপক আবুল হাসান চৌধুরী, আলোচনায় অংশ নেন ভীষ্মদেব চৌধুরী, শরদিন্দু ভট্টাচার্য, সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী।
সাকার মুস্তাফার পরিচালনায় সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে ‘ভাবনগর ফাউন্ডেশন’ এবং সালাউদ্দীন বাদলের পরিচালনায় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী’র শিল্পীরা। গান করেন স্বপ্না রায়, আবু বকর সিদ্দিক, সালমা চৌধুরী, শতাব্দী রায়, মেহেরুন আশরাফ, লাকী সরকার এবং খোকন বাউল। সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকা শিশু চত্বরের পাশের একটি স্টলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তবে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই তা নিভিয়ে ফেলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।