মেয়েটি 'এমন' হওয়ার রহস্য

ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন মেয়েটি। ২০১৩ সালে দশম শ্রেণিতে ওঠার পর হঠাৎ বদলে যায় তাঁর আচরণ। বেশি বেশি সাজগোজ করতে থাকেন। পরীক্ষার খাতায় গানের লাইন লিখে ফেলেন। একা একা এখানে-ওখানে চলে যান। ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার ঝোঁক বেড়ে যায়। একসময় বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনাও।

মেয়েটির বদলে যাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খায় তাঁর পরিবার। এই আনন্দ, তো এই বিষাদ। মেয়েটির মা বলেন, তাঁর মেয়ে প্রায় এক বছর ঘর থেকেই বের হয়নি। মানুষ দেখলে ভয় পেত। আত্মহত্যা করতে চাইত। আবার একটা সময়ে ঘরে রাখাই কঠিন হয়ে যেত। পছন্দ হয়নি বলে এ পর্যন্ত প্রায় ১০টি মোবাইল ফোন সেট ভেঙেছে।

মেয়েটির বাড়ি কুমিল্লায়। তার এই অদ্ভুত আচরণের সুযোগ নিয়েছে অনেকে। কেউ কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে বললেই তার সঙ্গে চলে যেতেন তিনি। ঢাকা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় একা একা চলে যেতেন। সুযোগ বুঝে অনেকে তাকে যৌন হয়রানি করেছেন। অনেকে ধর্ষণ করেছেন। পরিবার বলছে, এ পর্যন্ত কয়েকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মেয়েটি।

আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই তাঁকে ‘মন্দ মেয়ে’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মা-বাবাও বকাঝকা করেছেন অনেক। কিন্তু তিনি যে অসুস্থ হতে পারেন, কেউ ভাবেননি। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন কুমিল্লায় সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত মোস্তফা কামাল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করেন মেয়েটিকে। সেখানেই গত মঙ্গলবার মেয়েটি ও তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় হাসপাতালের চিকিৎসক তাজুল ইসলাম, নাসরীন আক্তার, শাফিয়া খানম ও মাহফুজা ইয়াসমীন উপস্থিত ছিলেন।

চিকিৎসক অধ্যাপক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রোগী একসময় ভালো ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু পরে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বেশি সাজগোজ করা, নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করা, বেশি কথা বলা, বেশি কেনাকাটা করা, ছেলেদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া, ঘরের বাইরে চলে যাওয়াসহ অনেক কিছু করতে থাকেন। তিনি সব বুঝতে পারতেন, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। এলাকায় এই রোগীকে সবাই “পাগল” ও “মন্দ মেয়ে” বলে ডাকত। তাঁর বাবা নেই। এক ভাই থাকলেও পরিবার সেভাবে মেয়েটির দায়িত্ব নেয়নি। ফলে প্রতিনিয়ত তার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। সমাজের লোকজন পাগল বলেই দায়িত্ব শেষ করেছে। কুমিল্লা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই রোগী একাধিকবার ভর্তি হলেও চিকিৎসকেরাও বুঝতে পারেননি যে তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত।’

তাজুল ইসলাম জানান, মেয়েটি বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। এ ধরনের রোগীরা একসময় অনেক আনন্দে থাকে। একসময় প্রচণ্ড বিষণ্নতায় ভোগে। এই রোগীরা যখন আনন্দে থাকে, তখন যৌন চাহিদা বেড়ে যায়। সে কারণেই বিপরীত লিঙ্গের দিকে ঝোঁকে। নিয়মিত ওষুধ খেলে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে যেকোনো সময় রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। তাই পরিবার, কমিউনিটি, চিকিৎসক ও সমাজকে রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে।

কথা হলো মেয়েটির সঙ্গে। বললেন, বিপদে পড়লে যাঁদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, তাঁরা সুযোগ বুঝে নানাভাবে যৌন নির্যাতন করেছেন। একপর্যায়ে বললেন, ‘আমাকে যদি তিন বছর আগে এই হাসপাতালে ভর্তি করত, আমার জীবনে এতগুলো ঘটনা ঘটত না।’

মেয়েটির মা বললেন, কোনো রোগের কারণে মেয়ে এমন করছে, তা বুঝতে পারেননি। এই হাসপাতালে ভর্তির পর বুঝতে পেরেছেন, মেয়ের কোনো দোষ ছিল না।