মেয়েদের হয়ে তো ঈদের দিনটার কথা ভাবিনি

নারী
প্রতীকী ছবি

কোনো দিনও কি ঈদটাকে দেখেছি মেয়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে? নারীর চোখে? আমরা বলি, ঈদে আমরা যাই উৎসে, গ্রামের বাড়ি, দেশের বাড়ি—কিন্তু মেয়েরা কই যান? মেয়েরা যান শ্বশুরবাড়ি। সাধারণত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা-ই হয়ে থাকে। ছেলেরা যখন তার আদিবাড়িতে যায়, পুরোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে, পুরোনো সহপাঠীরা মিলে হুল্লোড় করে; মেয়েরা তখন যান তাঁর শৈশবের স্মৃতিমাখা বাড়িটি থেকে অনেক দূরে। যান শ্বশুরবাড়িকে নিজের বাড়ি করে তুলতে, শাশুড়ি মাকে নিজের মা বলে জ্ঞান করতে, দেবরকে নিজের ভাই হিসেবে স্নেহচ্ছায়া দিতে। আমাদের রংপুর জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা ব্যাচে ব্যাচে পুনর্মিলনী করে। রংপুর জিলা স্কুলে তো এবার প্রাক্তন ছাত্রদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টও বসছে! কিন্তু মেয়েদের বেলা! আমার স্ত্রী যদি আমার সঙ্গে রংপুর যেতেন, সেটা তাঁর শৈশবের স্মৃতি তাঁর হৃদয় খুঁড়ে উত্তোলন করে আনত না! তিনি বরং ঈদের দিন মিস করতেন তাঁর আব্বা-আম্মা-বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীদের। রংপুর জিলা স্কুলের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে তাঁর কীই-বা এসে যাবে?

অন্যদিকে, ঈদে যে আমরা এত আয়োজন করি, সেই আয়োজনের জাহাজটির কাপ্তান কে? বাড়ির গৃহকর্ত্রী। আমাদের রংপুরের বাসায় ছিলেন আমার আম্মা। আমার এখনকার ঢাকার ফ্ল্যাটবাড়িতে আমার স্ত্রী। কাকে কী দিতে হবে, ঈদের উপহার, জামা-শাড়ি-পাঞ্জাবি—সেসব থেকে শুরু করে কী রান্না হবে, সবটাই তো বাড়ির মেয়েদেরই সামলাতে হয়! তাঁরা চানরাতে ঘুমুতে যান সবার শেষে। ঈদের ভোরে ওঠেন সবার আগে। ঈদের নামাজে যাচ্ছি, যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করা সুন্নত, টেবিলে খাবার প্রস্তুত—কীভাবে কোন জাদুবলে সবকিছু প্রস্তুত হয়ে রইল!

ম্যালা রাত পর্যন্ত রান্না হয়েছে। ছোটবেলায় রংপুরের বাসায় মুরগি জবাই করতাম আমি, বা আমার ভাইয়েরা, আর বঁটিতে সেসব কুটতে বসতেন আম্মারা। আমি তো বলি, আমাদের মধ্যে কে পারবে গিলা বের করতে? মেয়েরা পারবেন। কোনো কোনো ছেলেও পারেন। যাঁরা পারেন, আর করেন, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই। তো কাটা-বাছা, রান্না করার পরই তো কাজ শেষ হয়ে যায় না। সেসব মিছিল-সিজিল করে রাখতে হয়।

[সিজিল-এর বাংলা অর্থ [সিজিল্‌] (বিশেষ্য) ১ পারিপাট্য; ব্যবস্থা (শৃঙ্খলা সিজিল কিছু নেই-কাজী নজরুল ইসলাম)।] আছে সার সার ডেকচি-হাঁড়ি-পাতিল-চামচ বাসনকোসন মাজা। অমর্ত্য সেনকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলো কেন? তিনি রসিকতার সুরে বলেছিলেন, বাসনকোসনের জন্য। মানে? খাওয়ার পর বাসনকোসন কে মাজবে, এ নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় অমর্ত্য-নবনীতা আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।

ঈদের দিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আসবেন অতিথিরা। একজন করে আসছেন। টেবিলে বসছেন। খাচ্ছেন, খাচ্ছেন না। ‘সবার দুয়ার খোলা আজি/ কোথাও নেই মানা/ খাঞ্জা ভরে বিলাব আজ/ নানা রকম রকম খানা।’

তারপর? অতিথি বিদায় নেওয়ার আগেই থালাবাসন পরিষ্কার করতে হবে। টেবিল আবার রেডি। এ-ই চলবে বহু রাত পর্যন্ত। আমি ফুলবাবুটি তো ভাঁজভাঙা পাঞ্জাবি পরে নামাজ সেরে এসে ঈদসংখ্যা ওল্টাচ্ছি। টেলিভিশনের রিমোট টিপছি। বড়জোর ফেসবুকে লিখছি: ঈদ মোবারক। মেয়েদের সংগ্রাম চলছেই।

এর মধ্যে খবরে দেখলাম, কাল থেকে অনেক এলাকায় তিতাসের গ্যাসের সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। আমাদের এলাকায় চাপ কম থাকবে। অনেক এলাকায় থাকবেই না। এই ধকল কে সামলাবেন? সংসারের নারীকেই তো সামলাতে হবে, সংসারের চাপ আর গ্যাসের চাপ না থাকার চাপ।

আগেকার দিনে আম্মারা তো সেলাই মেশিন নিয়েও বসতেন। ঈদের আগে বাচ্চাকাচ্চাদের জামা তাঁরাই সেলাই করতেন।

অর্থাৎ ঈদের আনন্দ সবার, কিন্তু ধকলের সিংহভাগ নারীদের। বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের। বাবার ঘরে মেয়েরা হয়তো ভালোই থাকে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে? কেমন থাকে, কেউ আমরা কোনো দিন ভেবে দেখি না। জিগ্যেস করি না।

ঈদের দিন বোধ হয় মেয়েদের কাছে আরেকবার মাফ চাওয়া উচিত বাড়ির পুরুষদের।
তবে নারীরা কিন্তু করেই আনন্দ পান। ভুলতে পারি না, আমাকে খেতে বসিয়ে আম্মা যে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আমি খেলে সেই খাবার তাঁরই পাকস্থলীতে যেন পড়ত, সেই স্মৃতি তো আমার চির অমলিন থাকবে। এখন মেরিনাও কিছু রেঁধে আমাকে খেতে দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ভালো বললে কী খুশিটাই না হয়! এই মহত্ত্বটা সৃষ্টিকর্তা তাঁদের দিয়েছেন। আমি ব্যাপারটাকে আরও মাহাত্ম্য দিয়ে তাঁদের রান্নাঘরে চিরবন্দী করে রাখার ফন্দি আঁটছি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘মাতা বা গৃহিণীর বিশেষ বিশেষ মোড়কেই তাদের পরিচয়। তাদের মনুষ্যত্বের যে স্বাতন্ত্র্যটি মোড়ক ছাড়িয়েও প্রকাশ পায় তা কখনো বা অস্বীকৃত, কখনো বা নিন্দিত। এমনিভাবে মেয়েরা মানুষের একটি অংশমাত্র হয়েছিল। সমাজের অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি মানুষের পূর্ণতা খর্ব হয়ে একটা প্রকান্ড লোকসান ঘটিয়ে এসেছে। আজ এল এমন যুগ মেয়েরা মানবত্বের পূর্ণ মূল্য দাবি করছে।’ শুধু মাতা বা গৃহিণীর পরিচয়ের আড়ালে মনুষ্যত্বের পূর্ণতার অধিকার থেকে নারীকে যেন বঞ্চিত না করি।
আজ তাই ঈদের দিনে নারীদের দৃষ্টিকোণ বা পারস্পেকটিভ থেকেও উৎসবটাকে একটু দেখি না কেন। আমার চেয়ে যেকোনো নারী বিষয়টা অনেক ভালোভাবে উপলব্ধি আর প্রকাশ করতে পারবেন। আমি শুধু প্রসঙ্গটা পেড়ে রাখলাম। আর তাই ঈদের দিনে শুধু নারীদের আলাদা করে জানাই অনেক সালাম।

আর ধন্যবাদ জানাতে হবে আমাদের ঘরের পরিচারক-পরিচারিকাদের। আমাদের শকটচালকদের। আমাদের বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীদের। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। তাঁরাও তো নিজেদের ঘরবাড়ি–বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন ফেলে আমাদেরকেই স্বজন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ সুযোগে তাঁদেরও জানাই গভীর কৃতজ্ঞতা।
সবাইকেই জানাই ঈদ মোবারক।