মৌন নয়
বাসে সমস্ত প্যাসেঞ্জার চুপচাপ বসে আছে।
কিছুক্ষণ আগে যেন অনেক কথা হয়ে গেছে। অনেক অনেক কথা। তারই তর্জনী উঁচানো উদ্ধত শাসনে সব চুপ। পার্শ্বস্থ দ্রুতচারী গাছপালা থেকে আগত নীড়–সন্ধানী পাখিদের মিষ্টি চিৎকার, শুধু ব্যতিক্রম। অনেক, অনেক কথা ছড়ানো রয়েছে জীর্ণ বাসের কাঠের ফ্রেমে। এখন তাই সবাই স্তব্ধ। বিরহী কান্নায় বুক হালকা করে দিয়ে চেয়ে আছে বিষণ্ন দিগন্তের দিকে। আর কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। বাতাসের মর্মর শুধু কাজ করে যাক অন্ধকারে গলে পড়া পাতার ধমনিতে। পৃথিবী আর্তনাদ শুনুক। মানুষের মুখ বন্ধ থাক।
অস্পষ্ট আলো জ্বলছে বাসের ভেতরে।
কন্ডাক্টর ফ্রেমের শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্যাসেঞ্জার ডাকা আজ তার কর্তব্যের মধ্যে গণ্য নয়; হাটহাজারী বায়েজিদ বোস্তান নতুন–পাড়া তার মুখ থেকে খইয়ের মতো ফুটে বেরোয় অন্যান্য দিন। আজ কন্ডাক্টরের ছুটি অথবা কোনো প্যাসেঞ্জার প্রয়োজন নেই।
বাসের ঝাঁকুনির সঙ্গে সামাল দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে পাদানির ওপর। তারও দৃষ্টি অন্ধকারের দিকে বাসের জানালা ছাড়িয়ে। ওপাশে আকাশের গায়ে সীতাকুণ্ড পাহাড়–শাখার স্তব্ধ টিলারা কুঁজো হয়ে হয়ে দৌড়ের বাজি ধরেছে বাসের সঙ্গে। পাশে কালো নিস্তরঙ্গ মেঘের পটভূমি, যার বুক ফুঁড়ে কোনো নিঃসঙ্গ খেজুর কি অন্য কোনো বুনো গাছ গোধূলি হাওয়ায় দোল খাচ্ছে প্রবাহের সঙ্গ নিতে। কন্ডাক্টরের চোখে ঝাপসা আকার আয়তন শুধু আঁকা হয়, তার কোনো বস্তু–নাম থাকে না।
প্যাসেঞ্জার ১০–১২ জন। ড্রাইভারের পাশে একজন। তার মাথায় হ্যাট। কোনো অফিসার হওয়া সম্ভব। ওই মুখ দেখা যায় না অন্ধকারে। ড্রাইভারের সোজাসুজি গরাদের এপারে ঠিক মাঝখানে একজন বৃদ্ধ উপবিষ্ট। বাসের আলোয় তার মুখ স্পষ্ট। সাদা দাড়ি–ঘন চওড়া রেখায়িত মুখ, খাড়া নাক। ঈষৎ কোটরগত চোখের দুই পাশেও রেখার ভিড়। মাঝে দীর্ঘ নিশ্বাস গ্রহণের সময় বৃদ্ধ একেকবার চোখ খুলছে, তখন কোটরের গভীরতা উবে যায়—দীপ্তির আভাস স্বতঃই প্রকাশ পায়, নামাজকালীন তহরিমা বাঁধার মতো বুকে দুই হাত বেঁধে সে আছে। অবনত মুখ। দুই গণ্ডদেশের মাঝামাঝি নাক, আলোছায়ার জাল বুনে রেখেছে। তাই এই মুখে মনে হয় আদিম পাহাড়চূড়ায় খোদাই কোনো দরবেশের মূর্তি। গায়ে পিরহান ঝুলে পড়েছে পা–তক। কাঁধে লাল গামছা, পায়ে সাধারণ চটি। বসে আছে সে মৌন। নিশ্বাস নিতে তার ফোকলা গালে আরও খাদ সৃষ্টি হয়। আলোছায়ার অগোছালো বিকিরণ কোনো কঙ্কাল মুখ সৃষ্টি করে যার গর্তে গ্রামের দুষ্ট ছেলেরা যেন সাদা শন গুঁজে দিয়েছে জীবন্ত মানুষ তৈরির লোভে।
সমস্ত প্যাসেঞ্জারের দৃষ্টি প্রায়ই এই বৃদ্ধের ওপর নিবদ্ধ। অন্য সময় তারাও বাইরের দিকে চেয়ে থাকে।
বৃদ্ধের দুই পাশে দুজন চাষি। সম্মুখে বাসের মেঝেয় একজোড়া বাঁশের বজরা পড়ে আছে। কোনো জিনিস শহরে বিক্রি করতে গিয়েছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে হাটের শেষে। এই দুজনের পরনে লুঙ্গি। ঈষৎ শীতের আমেজ আছে বাতাসে, তাই গায়ে গামছা লেপটানো। তারাও চুপচাপ। দুজনে বৃদ্ধের দিকে ঘন ঘন তাকায়, তারপর মাথা নিচু করে কী যেন ভাবে। আবার জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
বাঁ পাশের চাষি একজন অনেকক্ষণ উসখুস করছিল। তার গলায় অস্বোয়াস্তি। পাকা বিড়িখোর সে। কিন্তু বিড়ি ধরাতে সাহস পায় না। কোনো পবিত্র আস্তানায় যেন সে বসে আছে, সম্মুখে পীর–পয়গম্বর—এখানে বিড়ি ধরানো বেয়াদবি। এমন ধৃষ্টতা তার মনুষ্যত্বের বাইরে। দেশলাই–বিড়ি বাঁ হাতে ধরে সে এমন জড় বনে গেছে, যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বৃদ্ধের দিকে একেকবার চায় আর মুখ নিচু করে সে।
ড্রাইভারের সোজাসুজি পাশবেঞ্চির ওপর একজন তরুণ। হাতে বই দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায় ছাত্র। গৌরবর্ণ মুখে কৈশোরের ছাপ একদম নিঃশেষে মুছে যায়নি। তার কৃশ লম্বাটে মুখাবয়ব পাষাণের মতো স্থির। চুপচাপ সে–ও। হাঁটুর ওপর হাঁটু তুলে অনড় হয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে পায়ের অস্বোয়াস্তি কাটাতে যখন সে হাঁটু বদলায়, তার পায়জামার নিচে বাদামি জুতার ঘষঘষ আওয়াজ হয়। কিন্তু এত মৃদু যে স্টিয়ারিং আর ইঞ্জিনের তোড়ে তা থ পায় না। একটা বাংলা বই খুলে সে একঘেয়েমি ধ্বংসের চেষ্টা পেয়েছিল। কিন্তু চোখ আজ বইয়ের পাতায় শান্তি পায় না। সমতল মাঠ, নতুন অফিস কি কারখানা ঘরের আলো ছাড়িয়ে টিলার ঘন কালো অন্ধকারই বোধ হয় চোখের শ্রেষ্ঠ বিশ্রামস্থল। কিসের ঝাপটা যেন ওই তরুণের মুখেও র্যাঁদা চালিয়ে এবড়োথেবড়ো অকর্ষিত জমি–জাত রুক্ষতা লেপে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে, হাতের মুঠি শক্ত করে সে আজ মনপ্রবাহের উজানে গুন টানছে।
ছাত্রটির সোজাসুজি সম্মুখের বেঞ্চির ওপর উপবিষ্ট একজন কেরানি ভদ্রলোক। উত্তরমুখী বাসের যাত্রাপথ। সে পশ্চিম দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে ঘাড় একটু কাত করে। কোনো অস্বোয়াস্তি যেন নেই তার এমন আসনে। নিবিড় অন্ধকারেই বরং সোয়াস্তি জড়ো হয়েছে। উধাও–গতি বাসের সঙ্গে মনের সমতা রক্ষা অন্ধকার আঁকড়েই সম্ভব। একটু হাত–পাও নড়ে না তার। ভদ্রলোকের পাশে আরও কয়েকজন আছে। ছোট বাল্বের আলো ফিকে, সবার মুখ দেখা যায় না। কিন্তু নিস্তব্ধতার ছোঁয়াচ তাদেরও রেহাই দেয়নি। ছাত্রের পাশে এমন আরও কয়েকজন। সবাই বোবা। কেউ কাশছে না পর্যন্ত। মফঃস্বলের উঁচু–নিচু পথে বাসের সফর সুখদায়ক নয়, গল্প–গুজবে এই অসুবিধা কিছু কমে। কিন্তু আজ কারও কোনো উৎসাহ নেই। একজন জানালার গরাদে মাথা চেপে ধরেছে জোরে। হয়তো মাথা ধরা অথবা ক্ষোভে জ্বালায় হাত–পা ছোড়ার অশোভনতা থেকে মুক্তির উপায়স্বরূপ এই পন্থা।
একটা লেভেলক্রসিং পার হতে বাসের গতি ধিমিয়ে এল। রেললাইনের দুই পাশে খাদ, জোনাকি উড়ছে হাজার হাজার। খেজুর ঝোপ শণ–চুল বুড়ির মতো বাতাসে উকুন খুঁজছে। ক্রসিংয়ের পর একটু খাড়াই পথ। মোটরের ইঞ্জিন গিয়ার বদলের সাথে কঁকিয়ে উঠল। আবার পুরাতন স্পিড ঝেঁটিয়ে যাচ্ছে গাছপালার সারি, ম্লান, ডিপা–জ্বলা অনিয়মস্তব্ধ চা খানা, গেরস্থর ঘরবাড়ি, অন্ধকার–লুপ্ত ফসল–শেষ নাড়া–বন। বর্ষা–ক্ষত পথের মধ্যস্থিত ছোট ফাটল পার হতে বাস বেশ ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল। আরোহীরা জানালার রেলিং কি বেঞ্চি ধরে তাল সামলে নিল, কোনো হইচই করল না কেউ—অথচ আনন্দের এমন সুযোগ মফঃস্বলে কে কবে অবহেলা করে? পথের ক্লান্তি হইচই দিয়ে ঠান্ডা হয়, কে না জানে! আবার সমান পাচ পথ। বাসের গতি সমান। একটু এগিয়ে যেতে এক পাশে ঝুলে পড়া মিন্জিরি গাছ বাসের গায়ে ডানা ঝটপট করে গেল। আজ কারও হুঁশ নেই। ড্রাইভারকে হুঁশিয়ারি ছাড়ছে না কেউ আগে থেকে। চোখে ডালপালা লাগতে পারে, এমন আশঙ্কাও নেই। হয়তো আজ কারও চোখ নিজের দিকে নেই। আর কোথাও—কোনো রক্তাক্ত রাজপথে, কি কোনো শোক–বিধুর গৃহ–প্রাঙ্গণে নির্বাকে থেমে আছে। সমস্ত বাংলাদেশের গাছপালা নদী–নালা খাল–বিল ছায়াপথ বন–জঙ্গল পার হয়ে দূরত্বের ব্যবধান উপেক্ষা করে, বর্বরতার সম্মুখে স্তব্ধ মিছিলের লক্ষ চোখের দৃষ্টির সঙ্গে মিশে গেছে—আজ একক চোখে তাই মনে হয় দৃষ্টি নেই। তাই তো পুরাতন অভ্যাস ভুলে গেছে যাত্রীরা। ড্রাইভারের বাঁ হাতে একটা হলুদ–পাতা ডালের হোঁচট লাগল, সে আত্মরক্ষায় হাত বাড়াল না, থামল না—যেমন থামল না ঐর তরুশাখা। স্পিড আরও বেড়ে গেল। পাতায় আলিঙ্গন–বদ্ধ অন্ধকারের খিড়কি তুলে নক্ষত্ররা তাকায়। আবার বোবা মাঠের বিস্তার, ওপরে খোলা আকাশ, তখন তারারা অনির্বাণ জিজ্ঞাসা–চিহ্নের মতো দেখায়। মৌন পূর্ব–বঙ্গ যেন ওইখানে জ্বলে জ্বলে জিজ্ঞাসা করছে: আমার শস্য–শ্যামলা হরিৎ প্রান্তর, তোমাদের এই অন্নাতুর কান্না কেন? তোমাদের ভাষা কোথায়? তোমরা স্তব্ধ কেন?
কেউ জবাব দেয় না! বাসের অভ্যন্তরে সবাই মূক। খটখট ইঞ্জিনের রব শুধু ফুঁসে উঠছে, তারও জবাব দেওয়ার কোনো ভাষা জানা নেই।
লোকালয় পার হয়ে এল যন্ত্র–শকট, এবার দুই পাশে বে–বহা মাঠ। একদিকে পাহাড়ের শিরদাঁড়া থমথমে অন্ধকারে ঝাপসা। সমতল জমির ওপর গাছপালার ছোট আঁধারের বিচিত্র স্তরবিন্যাস সৃষ্টি করেছে। পাড়ভাঙা শুকনো দিঘি, ঝাউয়ের পাহারা–ঘেরা পল্লি–পথের আত্মগোপনের ফাঁদ হেডলাইটের সম্মুখে ভেঙে যায়। আবার একাকার সব। টায়ারের নিচে মচমচ শব্দ শুধু জানান দেয়, এখানে বসন্তের হাওয়ায় অনেক পাতা ঝরছে, পাতায় পুরু এই পথ। কাঠের ব্রিজের চাকা ওঠার সময় ঢোলের মতো ডুগডুগ শব্দ হয়। এমন গতির মুখে ঝাউমর্মর বন কলভাষা কোনো দাগ কাটতে পারে না কানে। বাস চলছে চলছে। পৃথিবীতে এই এক মুহূর্তিক সত্য মাত্র জীবিত।
ছাত্রটির পাশে উপবিষ্ট কয়েকজনের মধ্যে একটি লোক বিড়ি বের করল। হাতে দেশলাই। অতি সন্তর্পিত—যেন তার কাজ কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে। বিড়ি ধরাবে ভাবছে সে। একটা দেশলাইয়ের কাঠিও সে বের করল খোল থেকে। সম্মুখের বেঞ্চি থেকে একজন হাত ইশারায় বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর মাথা নাড়ে। বিড়ি ধরিয়ো না—তোমার লজ্জা করে না? এমনই ভাবখানা। নেশাখোরের আর নেশা করা হলো না। শার্টের পকেটে দেশলাই ঢুকল, বিড়ি ঢুকল, দেশলাইয়ের কাঠি একাকী—ঢুকল। সন্তর্পণে ওই ব্যক্তি আবার যাত্রীদের দিকে চেয়ে দেখে, কেউ তাকিয়ে নেই তো? শান্তমুখে ভদ্রলোক অন্ধকারে নিজের দৃষ্টি ডুবিয়ে দিল। দুষ্কৃতি নিবারণকারী এতক্ষণ সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তারও চোখ জানালার বাইরে।
গোটা দুই বাঁক ফিরতে বাসের স্পিড সামান্য কমল। রাত্রির প্রহর শুধু কমে না। কমে না বাসের ভেতর স্তব্ধতার শাসন।
মাঠের সফর শেষ হয়ে গেল। আবার লোকালয় শুরু হয়েছে। দুপাশে ঝিমমারা ঘরবাড়ি, দহলিজ, কলা-বাঁশের বন। হেডলাইটের আলো তীক্ষ্ণধার এই সড়কে। একদম শীত যায়নি। ফিকে কুয়াশা গাছপালায়। অন্যান্য দিন পার্শ্ববর্তী দোকানে কলরব ওঠে। আজ লোক বসে আছে, কিন্তু গলাফাটা চঞ্চলতা নেই।
এই লোকালয়ের পর ছোট মাঠ শেষে, বাসের একজন যাত্রী উসখুস করে কন্ডাক্টরের দিকে তাকায়। কিন্তু কোনো কথা বলে না। হাবভাবে মনে হয়, তার গন্তব্যস্থান নিকটে। কন্ডাক্টরের চোখে পড়ল একবার। সে একটু উঠে এল ড্রাইভারের সোজাসুজি। তারপর গরাদের ভেতর হাত গলিয়ে চালকের হাতে একটু টিপ দিল। আর কোনো কথা হয় না। বোবার রাজ্যে ঠোঁট থাকা বৃথা।
পল্লি–পথের মুখ বড় সড়কে এসে মিশেছে। দু-পাশে দুটো মোটা কদমগাছ। আঁকাবাঁকা ধুলি-ধূসর পথের সর্পিলতা ওই দিকে অন্ধকারে উধাও। ওই ভদ্রলোক ধীরে ধীরে নেমে গেল। বারবার তার চোখ ওই মৌন বৃদ্ধের ওপর নিবন্ধ হয়। শেষবারের মতো সে দেখে নিল বাসের দরজা থেকে। কন্ডাক্টর ভাড়া নিয়ে গলায় ঝোলানো ব্যাগে রেখে দিল। আলোর কাছে হাতের তালু চওড়া করে খুচরা পয়সা গোনা আজ নিষ্প্রয়োজন। প্যাসেঞ্জার ঠকিয়ে যেতে পারে? কিন্তু আরও বিরাট ক্ষতির দাগা খেয়েছে সে, তাই এই লোকসান তুচ্ছ। কন্ডাক্টরের সত্যই মনে হয়, আজ তাকে প্রতারিত করে যাওয়ার মতো এত শঠ এই এলাকায় নেই।
আবার ধাবমান পথ, চাকা, গ্রামান্তর।
বৃদ্ধ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে একবার চোখ তুলে চাইল। কিন্তু চোখ তখনই বুজে যায়। বুঁদ আছে সে চিন্তার কড়া ঝাঁঝে। কিন্তু তারপরই সমস্ত বাসযাত্রীর মধ্যে স্তব্ধতা বেড়ে গেল। ছাত্রটি কী যেন বলতে গিয়ে থামল। বৃদ্ধের বৃদ্ধ মুঠি আরও শক্ত হয়ে উঠল। পার্শ্ববর্তী চাষি মাথা নাড়ল নিজের খেয়ালে—কোন আত্মকথোপকথনের বুদ্ধুদের আঘাতে হয়তো। কেরানি ভদ্রলোকের মুখাবয়ব ঋজু কাঠিন্যে নিথর হয়ে এল। অন্য যাত্রীদের দৃষ্টি তখন বাসের অভ্যন্তরে। কন্ডাক্টর বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল, সে–ও নিঃশব্দে উঠে এল।
শুধু মোটরবাস নিজের চলাপথে নির্বিকার। তার অন্ত-আলোড়ন খটখট রবে, দুপাশের ফেলে আসা প্রকৃতির সমারোহে শব্দায়িত।
আবার মৌনতার প্লাবন।
পাড়াগাঁ–এখনো নিশুত হয়ে যায়নি। পিদিম জ্বলছে উঠানে, ইটের পাঁজা তুলছে পাঁজারিরা খোলা মাঠে। কিন্তু এই সজীবতা বাসযাত্রীদের ছুঁতে পারে না। এখানে মড়ার রাজ্য। কঙ্কালের মতো সবাই বসে আছে। এত মানুষের নিশ্বাসও যেন মাথা তুলতে পারছে না নীরবতার বুকে। চাষির হাত থেকে দেশলাই খসে পড়ল খড়খড় শব্দে। কিন্তু তা তুলতে গিয়ে নীরবতার পবিত্রতাহানি, তার মনুষ্যত্বে বাধে। চাষির কণ্ঠনালির ওপরে একটু দোলা লাগল। হয়তো চোয়াল আরও শক্ত করতে বা মুখের ‘আব’ ঘোচাতে।
আরও দুই মাইল পরে বাসের গন্তব্যস্থান। নির্বিকার যাত্রী দল বসে আছে। কারও কোনো উদ্বেগ নেই, তাড়াহুড়া নেই বাড়ি ফেরার। বৃদ্ধের দুই হাত বুকে বাঁধা। সে–ও গন্তব্য–পথের হদিস জানে না। কিন্তু তার নিশ্বাস যেন দ্রুততর হচ্ছে। কয়েকজন যাত্রীর দৃষ্টি আবার বাইরে থেকে ওই মুখের ওপর পড়ে।
বৃদ্ধের নিশ্বাস আরও দ্রুত, আরও ঘন। যেন ডুবে যাচ্ছে সে। কুঁচকে ঢলে পড়ল, পা একটু সটান, প্রসারিত হলো তার।
হঠাৎ হাঁপ ছাড়তে গিয়ে বৃদ্ধের কণ্ঠনালি আর স্থির থাকে না। শক্ত কফ জমেছে যেন গলার দুপাশে। ফোকলা গাল বারবার ওঠানামা করে। ঠোঁট কেঁপে উঠল। অসহ্য কি যেন বুক থেকে ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠছে।
চোখের দৃষ্টি অপলক, বৃদ্ধ এইবার ডুকরে আর্তনাদ করে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে চুরমার হয়ে গেল নীরবতার জগদ্দল।
‘কী দোষ করেছিল আমার ছেলে? ওরা কেন তাকে গুলি করে মারল? কী দোষ—কী দোষ করেছিল সে? উঃ...’
কী দোষ করেছিল সে? এই জিজ্ঞাসা চিহ্ন ভাসছে তার চোখের ওপর। এখনই মুখ থুবড়ে পড়বে বৃদ্ধ বাসের মেঝেতে।
সমস্ত যাত্রী তখন নিজের জায়গা ছেড়ে বৃদ্ধের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। চাষি দুজন তার কোমর জড়িয়ে ধরল যেন পড়ে না যায়। ড্রাইভারের এক হাতে স্টিয়ারিং, অন্য হাত সে সবার আগেই বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
জোড়া জোড়া জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে পড়ে। দমকে দমকে সিংহ গর্জন এখনই ফেটে পড়বে। সকলের গলার রগ কেঁপে কেঁপে উঠছে দমকে–দমকে।
নির্বিকার গাড়ি শুধু এগোতে লাগল।
সূত্র: একুশে ফেব্রুয়ারী, সম্পাদক: হাসান হাফিজুর রহমান, ১৯৫৩