ম্রিয়মাণ মহানগর লাইব্রেরি

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মহানগর লাইব্রেরি। মঙ্গলবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মহানগর লাইব্রেরি। মঙ্গলবার তোলা ছবি l প্রথম আলো

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় পাঁচতলায়। তবু প্রতিদিন কিছু লোক ওঠেন। এখানে যে মহানগর লাইব্রেরি! একদিকে দুটি টেবিলের চারপাশে গোটা বিশেক চেয়ার নিয়ে পত্রিকা পাঠের কক্ষ। টেবিলে ছড়ানো ১৮টি দৈনিক। পিনপতন নীরবতায় নিবিড় মনোযোগে কাগজ পাঠ করছেন নয়জন পাঠক। তিনজন তরুণ, ছয়জন বয়সী। অন্যদিকে রয়েছে সুপরিসর বইপাঠ কক্ষ। ভালো করে খুঁজে-গুনে দেখা গেল, পাঠক সাকল্যে তিনজন! আর পাঠকক্ষে সহকারীও আছেন তিনজন, প্রায় সবাই ঘুমে ঢুলুঢুলু! ২ অক্টোবর দুপুর বেলার দৃশ্য এটি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রমগুলোর মধ্যে পড়ে পাঠক সৃষ্টি করা, বেসরকারি গ্রন্থাগারের উন্নয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি অনুদানের বই ও অর্থ গ্রন্থাগারে সরবরাহ, দেশে বইমেলার আয়োজন, বিদেশে বইমেলায় অংশগ্রহণ এবং বই ও প্রকাশনা বিষয়ে সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করা। গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের পূর্ব দিকে বিবর্ণ ভবনটিই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ১৮ হাজার বইয়ে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারটির নাম ‘মহানগর লাইব্রেরি’।
অর্ধশতাব্দী পুরোনো প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। একটু পেছন ফিরে তাকাতে হয়। ইউনেসকোর ঘোষণা ও তৎকালীন জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের আলোকে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল বুক সেন্টার ফর পাকিস্তান। এর একটি শাখা অফিস ঢাকায়ও ছিল। স্বাধীনতার পরে ওই প্রতিষ্ঠানটি ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। গুলিস্তানে নিজস্ব ভবনে দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে ১৯৭৮ সাল থেকে।
মহানগর লাইব্রেরিতে সব থেকেও যেন অনেক কিছুর অভাব। একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের মগবাজার শাখায় চাকরি করেন মাইনুদ্দিন হোসেন। কাজের অবসরে প্রায়ই এখানে এসে পত্রিকা পড়েন। দুটি সমস্যার কথা জানালেন তিনি। প্রথমত, যেহেতু লিফট নেই, তাই গ্রন্থাগারটি প্রথম তলায় হলে ভালো হতো। আর দ্বিতীয়ত, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা থাকলেও ঘড়িতে চারটা বেজে গেলেই বন্ধ করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন কর্মীরা। মাইনুদ্দিনের পরামর্শ—এখানকার কর্মীদের প্রবেশ ও বেরোনোর ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ ব্যবস্থা চালু করা হলে জবাবদিহি বাড়ত।
প্রথম দিকে মহানগর লাইব্রেরিটি ছিল ওসমানী উদ্যানের ভেতর। ওই ভবনটি ভাঙা পড়লে ১৯৯৭ সালে এখানকার পঞ্চম তলায় উঠে আসে লাইব্রেরিটি।
লাইব্রেরির পাঠকক্ষে বইপাঠে নিবেদিতপ্রাণ কয়েকজন পাঠকের দেখা মেলে। ফারুক হাসান ১৪-১৫ বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা করেন। সাহিত্য, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই তাঁর বেশি আগ্রহ। একসময় সাংবাদিকতা করতেন। তাঁর মতে, এখানে পড়ার পরিবেশ ভালো। তবে সমস্যা হলো বিন্যাস ঠিক না থাকায় কোন বইটি কোথায় আছে, সে সম্পর্কে কর্মীদের স্পষ্ট ধারণার অভাব। ফারুকের পর্যবেক্ষণ, এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক বই কম। বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে মৌলিক গ্রন্থেরও অভাব আছে। তাঁর মতে, প্রতিদিন এখানে গড়ে পাঠক আসেন ২০-২২ জন। এর মধ্যে কয়েকজন আছেন রোজ আসেন।
আরেকজন পাঠকের কথা উল্লেখ করতে হয়। শামসুজ্জামান। নবাবপুরে যন্ত্রাংশ বিক্রির ব্যবসা। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। মুগদাপাড়ায় নিজের বাড়ি। তিনিও দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত এখানে কাটান। গত ১৩-১৪ বছর এই এক রুটিনেই চলছেন। প্রশ্ন করি, দোকানে বসতে হয় না? শামসুজ্জামান বলেন, ‘আমার ছোট ভাই বসে। আর বেচাকেনাও কম।’ কী ধরনের বই পড়েন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বই বেশি পড়ি।’
প্রায় প্রতিদিন দেখা হওয়ায় ফারুক হাসান, শামসুজ্জামানসহ আরও কয়েক জন এখন বন্ধু হয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকেই ঘর থেকে খাবার নিয়ে আসেন। এখানে বসেই খেয়ে নেন।
সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে সদ্য যোগ দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর কুমারেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বর্তমানে কিছুটা আধুনিকায়নের কাজে হাত দিয়েছেন তাঁরা। ওয়েবসাইট তৈরির কাজও এগিয়ে চলছে।
কুমারেশ বলেন, পাঠের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় প্রতিবছর গড়ে তিন হাজার বই সরিয়ে নেওয়া হয়। আর বছরে কেনা হয় পাঁচ লাখ টাকার বই।
এখানকার দীর্ঘদিনের গ্রন্থাগারিক মো. আমিনুল ইসলামের ভাষ্য—গুলিস্তান একটা ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। শব্দদূষণের কারণে পাঠকদের অসুবিধা হয়। এটাই বাস্তবতা। তিনি কাগজপত্র দেখে বলেন, মহানগর লাইব্রেরি আধুনিকায়ন করতে প্রায় ৬৫ লাখ টাকার একটা প্রস্তাব তাঁরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র, কম্পিউটার ও সফটওয়্যার ক্রয়, প্রবেশপথসহ সব জানালায় থাই গ্লাস বসানো, ফ্লোরের জন্য টাইলস কেনা, প্রবেশপথে কাউন্টার বসানো। এখন তাঁরা প্রস্তাবটি অনুমোদিত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
তবে নিয়মিত পাঠকেরা মনে করেন, এসব বড় কাজ করা তো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আপাতত ছোট কাজগুলো করা বেশি জরুরি। বিনয়ের সঙ্গে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠক ভাষ্য—পাঁচতলার প্রক্ষালন কক্ষটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। এটা কেন ঠিক করা হবে না?